ছয় মঞ্জিল প্রসঙ্গ : আলমে আজসাদ বা দুনিয়ার জগত (৪র্থ পর্ব)

সন্তানের প্রতি অভিভাবকগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য

সন্তানের প্রতি অভিভাবকগণের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে নির্দেশ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান- ‘সন্তানদের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখন তোমরা তাদেরকে নামায পড়ার নির্দেশ দাও। দশ বছর বয়সে পৌঁছালে তাদেরকে নামাযের জন্য প্রহার (শাসন) করো এবং পরস্পরের বিছানা পৃথক করে দাও।’[1]

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ব্যাখ্যাকার মোল্লা আলী কারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, সাত বছর বয়সে সন্তানকে নামাযের নির্দেশ দেওয়ার কথা এ জন্য বলা হয়েছে যে, এ বয়সে সন্তানের মধ্যে নতুন এক শক্তি সঞ্চার হয়। আর এর পরবর্তী সাত বছর হচ্ছে বালেগ হওয়ার বয়স। তাই নামায পড়া অভ্যাসে পরিণত করতে শাসনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামী সিপাহসালার আল্লামা আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, সন্তানের বয়স দশ বছরে পৌঁছালে তার মধ্যে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং এ সময়টা বালেগ হওয়ার একেবারে কাছাকাছি বয়স। তাই এ বয়সে শরীয়তের বিধি-বিধান তথা নামায-রোযা ইত্যাদি পালনে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে।

সন্তানদের বিছানা পৃথক করার নির্দেশ এ জন্য দেওয়া হয়েছে যে, এ বয়সে তাদের মধ্যে বিভিন্ন অনুভূতি চলে আসে। মোল্লা আলী কারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যদি পৃথক বিছানার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে একত্রে রাখাও জায়েয হবে তবে শারীরিকভাবে পৃথক থাকতে হবে।

আমার আব্বাজান হযরত বর্ণভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আমাদের শৈশব ও কৈশোরে শরয়ী বিধিবিধান ও সুন্নাতের উপর পাবন্দীর প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। খানার সময় তিনি আমাদের সাথে নিয়ে খেতেন। বিসমিল্লাহ ও দুআ পড়ে আমরা খানা শুরু করছি কি না তা লক্ষ্য রাখতেন। খানার শুরুতে বিসমিল্লাহ ভুলে গেলে খানার মধ্যেবর্তী দুআ ‘বিসমিল্লাহি আউয়ালাহু ওয়া আখিরাহু’ পড়তে তাগিদ দিতেন। খানাপিনা ও সকল উত্তম কাজে ডান হাতে ও ডান দিক হতে আরম্ভ করার তালীম দিতেন। খানা শেষে আঙুল চেটে ও প্লেট মুছে খাওয়ার তাগিদ দিতেন। আমাল ও সুন্নাতের অনুসরণে উৎসাহ বাড়াতে পুরস্কারের ঘোষণা দিতেন। নামায পড়া ও জামাতে অংশগ্রহণের বিষয়ে খুব বেশি খেয়াল রাখতেন। ছবি ও ফটো ওঠাতে নিষেধ করতেন। অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বই যেগুলো গুনাহের দিকে ধাবিত করে সেগুলো পড়তে নিষেধ করতেন। টাখনুর উপরে লুঙ্গী-পায়জামা পরার নির্দেশ দিতেন। কখনোই আমাদেরকে শর্টপ্যান্ট ও টাই পরান নাই। সালামের সুন্নাত যিন্দা রাখতে বেশি বেশি সালাম করার কথা বলতেন। তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হাদীসখানা আমাদের প্রায়ই শোনাতেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ছোটদের স্নেহ করে না আর বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’

আব্বাজান আরো বলতেন, কেউ যদি বড় হয়ে যায়, তাহলে তোমরা তাকে হিংসা করবে না। কেননা, হিংসা হচ্ছে বড় পাপ যা নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়।

আমি আম্মাজানকে হারিয়েছি ১১ মাস বয়সে। তিনি খুবই পরহেযগার মহিলা ছিলেন বলে সবার জানা। আল্লাহপাক আব্বা-আম্মা উভয়কে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।

বাবা-মা ও অভিভাবকগণের জেনে রাখা দরকার যে, সন্তান লালন-পালনে যেভাবে অনেক সওয়াব, তেমনি অবহেলাকরণে রয়েছে মহাপাপ। বিশেষভাবে শিশুশিক্ষার ব্যাপারে খুব সজাগ থাকতে হবে। আদর্শ নেককার শিক্ষকের নিকট পাঠিয়ে শিশুকে কুরআন শরীফ ও দ্বীনিয়াতের মৌলিক শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চাদের জন্য আদর্শ নেককার শিক্ষক নির্বাচন করার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লামা ইবনে সিরীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- ‘দ্বীন শিখার মাধ্যম (শিক্ষকবৃন্দ) হচ্ছে দ্বীনের অংশবিশেষ। সুতরাং তোমরা লক্ষ করো যে, এই দ্বীন তোমরা কার কাছ থেকে গ্রহণ করছ।’

সহীহ তরীকার মাদরাসাগুলোতে লেখাপড়া করে সন্তান কখনো বেদ্বীন হয় না। এর কারণ, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক হন পরহেযগার, সহীহ তরীকার অনুসারী ও আদর্শবান। পক্ষান্তরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষকগণের মধ্যে এই গুণাবলি না থাকায় তাদের কাছে যারা লেখাপড়া করে তারা কখনো মুরতাদ পর্যন্ত হয়ে যায়। সুতরাং সন্তানদের আদর্শবান ধার্মিক হয়ে গড়ে উঠতে প্রয়োজন আদর্শ অভিভাবক ও ধার্মিক শিক্ষক।

আলমে আজসাদে অবস্থানকারী সকল মুমিন-মুমিনা ও অভিভাবকগণের প্রতি আল্লাহপাকের নির্দেশ হলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়া অবলম্বন করা ও সত্যবাদীদের সাথী হওয়া।

সন্তানদেরকে জান্নাতের পথের পথিক বানাতে ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দানের লক্ষ্যে সৎসঙ্গ লাভের প্রতি দৃষ্টি রাখা মা-বাবা ও অভিভাবকগণের কর্তব্য। সন্তানরা যাতে কোনো অসৎ, পাপিষ্ট, চোর, ডাকাত ও বাতিলপন্থীলোকের সঙ্গ গ্রহণ না করে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে।

অসৎ সঙ্গ বিষাক্ত ও বিষতুল্য। দূষিত পরিবেশে শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হলে এর প্রভাব পরবর্তীজীবনেও থেকে যায়। তাই সন্তানদের জন্য দ্বীনদার পরহেযগার সাথী নির্বাচন করা চাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সৎ বন্ধুর দৃষ্টান্ত হলো মিশক বিক্রেতার ন্যায়। হয়তো তুমি তার থেকে আতর ক্রয় করবে নয়তো তোমাকে খুশবু হাদিয়া দেবে অথবা খুশবু হতে কিছুটা হলেও তুমি ঘ্রাণ পাবে। পক্ষান্তরে অসৎ বন্ধুর দৃষ্টান্ত হলো চুলায় লাকড়ি নিক্ষেপকারীর মতো। হয়তো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে আর না হয় অন্তত ধোঁয়ার দুর্গন্ধ হলেও তুমি পাবে।[2]

 

সৎসঙ্গের বরকত

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পরের ঘটনা। সাহাবিয়া হযরত উম্মে সুলাইম রাযিয়াল্লাহু আনহা সিদ্ধান্ত নিলেন কলিজার টুকরা ৯/১০ বছরের আদরের সন্তান আনাসকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুহবতে খেদমতের জন্য উৎসর্গ করবেন। দরবারে নববীতে সন্তানসহ হাজির হলেন। অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। ইয়া রাসূল্লাল্লাহ! আমার কলিজার টুকরা আনাসকে আপনার খেদমতে উৎসর্গ করতে এসেছি। মেহেরবানী করে আমার আবেদন কবুল করুন। দয়ার নবী সাহাবিয়ার আবেদন মঞ্জুর করলেন। নবীজির সুহবতে খেদমতের উদ্দেশ্যে সন্তানকে রেখে স্নেহময়ী মা চলে গেলেন। অবুঝ শিশু আনাস শিশুসুলভ আচার-আচরণে দরবারে নববীতে খেদমতে নিয়োজিত। প্রবাদে আছে ‘শিশু তো শিশুই, যদি সে নবীও হয়’। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তথাপি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় আদর-সোহাগ ও স্নেহ-মমতা দিয়ে তাঁকে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন। জাহিলী সমাজে জন্ম নেওয়া শিশুটিকে নবীজি তাঁর পবিত্র সুহবত দিয়ে জান্নাতী সৌভাগ্যবান মানুষে রূপান্তরিত করেন। তাঁর জন্য বিশেষভাবে তিনটি দুআ করেন- ‘হে আল্লাহ! আনাসের সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি করে দাও এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও।’

হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবদ্দশায় তাঁর সন্তানের সংখ্যা একশতের বেশি ছিল এবং তাঁর সম্পদে এমন বরকত হয়েছিল যে, অন্যান্যদের বাগানে বৎসরে একবার ফল আসত আর তাঁর বাগানে বছরে দুইবার আসত। তিনি বলতেন, ‘আমি জান্নাতে প্রবেশের আশা রাখি।’

এগুলো ছিল সৎসঙ্গ তথা নেক সুহবতের ফল।

[1] আবু দাউদ : ৪৯৫

[2] মুসলিম : ৬৫৮৬

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT