ছয় মঞ্জিল প্রসঙ্গ : আলমে আজসাদ বা দুনিয়ার জগত (১১তম পর্ব)

তাকওয়া অবলম্বনের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, চোখ, যবান, হাত, কান, গুপ্তাঙ্গ- এ পাঁচ অঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। কোনোভাবেই যেন এ পাঁচ অঙ্গ গুনাহের কোনো কাজে লিপ্ত না হতে পারে।

চোখের হেফাজত

কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে—

চক্ষু সমূহের খেয়ানত (অন্যায় কর্মসমূহ) এবং অন্তরসমূহ যা গোপন রাখে সে ব্যাপারে তিনি (আল্লাহ তাআলা) জানেন।”[1]

চোখকে হেফাজত করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। চোখ দ্বারা গুনাহ সংঘটিত হলে তার প্রভাব অন্তরে গিয়ে পড়ে। অন্তর ও দেমাগ তখন খারাপ হয়ে যায়। সুতরাং, খারাপ কোনো কিছু দেখার বা কুদৃষ্টি দেওয়ার মওকা তৈরি হলে মনের মধ্যে এই ভাবনা হাজির করা চাই যে, আমার এ সকল ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড আল্লাহ পাক তো দেখছেন! আল্লাহ পাক তো বান্দার সকল কিছু সর্বদা দেখেন এবং জানেন!

দেখবেন, আপনার ভেতরে তখন একটি বাধা তৈরি হবে, আপনি কুদৃষ্টি থেকে নিজেকে সংযত রাখার মওকা পেয়ে যাবেন। কিন্তু এ ভাবনা হাজিরের পরও যদি আপনি নফসে আম্মারার ধোঁকায় পড়ে যান তাহলে এটা আপনার বদকিসমত, আপনি আল্লাহ তাআলার দিকে আরও বেশি মনোযোগী হোন। আরও বেশি করে ইস্তেগফার করুণ দিল লাগিয়ে।

সাইয়্যিদুল আইম্মা ইমামে আযম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে এ কথা মশহুর আছে যে, তাঁর বিখ্যাত শাগরিদ হানাফী মাযহাবের অন্যতম ইমাম মুহাম্মাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যখন তাঁর দারসে বসতেন তখন নিতান্ত বালক ছিলেন। দাড়িগোফ গজায়নি। আবার দেখতে খুব সুন্দর ও সুশ্রীও ছিলেন। ফলে পড়াশোনায় ভালো হবার পরও ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলায়হি দরসে তাঁকে নিজের সামনে বসতে দিতেন না। বলতেন দৃষ্টির আড়ালে পেছনের সারিতে যেন বসেন। যাতে করে ইমাম আবু হানীফার নজর তাঁর দিকে না পড়ে।

চিন্তা করুন, কেমন তাকওয়া আর পরহেযগারি ছিল আমাদের মাযহাবের মহান ইমামের! কেননা, দাড়িগোফ-বিহীন সুশ্রী বালক মানুষকে ফিতনায় ফেলে দিতে পারে। এ ধরনের বালকের প্রতি নজর পড়লে অন্তরে খাহেশাত জেগে ওঠার আশঙ্কা প্রবল। তাকে নিজের কাছে ভেড়ানোর এবং অন্তরঙ্গ করে তোলার খাহেশ জাগবে মনে। সেখান থেকে ধাবিত করবে মারাত্মক গুনাহের কাজের দিকে।

সুতরাং, আকর্ষণীয় চেহারার বালক ও কিশোরদের সঙ্গে চলাফেরা, অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলা থেকে আমাদেরকে বাঁচতে হবে। তাদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকানো যাবে না। দৃষ্টির খেয়ানত হয়ে যাবার আশঙ্কা এখানে প্রবলভাবে বিদ্যমান। এ ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন বাঞ্চনীয়।

অবৈধ প্রেম-ভালোবাসার যে সয়লাব বর্তমান সমাজে, চোখের যথাযথ হেফাজতই পারে আপনাকে সেই ভেড়াজাল থেকে মুক্ত রাখতে।

ইয়াদ রাখবেন, গুপ্তাঙ্গের মতো চোখও কিন্তু যিনা করে! চোখের এই মহাপাপ থেকে বাঁচার তরিকা হলো, চলতে ফিরতে দৃষ্টি নিচের দিকে রাখা।

হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, ‘চোখের হেফাজতে দিলের হেফাজত। দিল হেফাজত না থাকলে, নষ্ট হয়ে গেলে গুপ্তাঙ্গের হেফাজত কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং চোখ নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ মুসিবতে পতিত হয়।’

চিন্তা করে দেখুন, আদম আলাইহিস সালামের পুত্র কাবিল যদি তাঁর ভাই হাবিলের বোনের প্রতি দৃষ্টি না দিতেন, তাহলে নিজের ভাই হাবিলকে হত্যা করতেন না। পৃথিবীর প্রথম হত্যাকারীর কলঙ্ক ও পাপও তাঁর আমলনামায় যুক্ত হতো না।

অনুরূপভাবে যুলাইখাও যিল্লতিতে পতিত হয়েছিলেন হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কারণে।

সুতরাং সর্বাবস্থায় আমাদের সবচেয়ে বড় করণীয় কাজগুলোর অন্যতম হলো দৃষ্টি ও নযরের হেফাজত করা। কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তওফীক দান করুন। আমীন।

যবানের হেফাজত

জনাব রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবী উকবা ইবনু আমির রাযিয়াল্লাহু আনহুকে নাজাত বা মুক্তিলাভের তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল যবানকে কন্ট্রোল রাখা। যবান কন্ট্রোল রাখার অর্থ হলো, অশ্লীল অশালীন অযথা কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা। মিথ্যা কথা না বলা। কাউকে লানত-অভিশাপ না দেওয়া। গালিগালাজ না করা।

দ্বিতীয় উপায় হলো, যথাসম্ভব ঘরে অবস্থান করা। বাইরে না বেরোনো। অযথা ঘোরাফেরা না করা।

তৃতীয় উপায় হলো, কৃত গুনাহের ব্যাপারে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি ও কান্নাকাটি করতে থাকা। আল্লাহ তাআলার কাছে মাফ চাইতে থাকা। বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া।

যবান অপচয়ের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হাসি-তামাশা ও মাত্রাতিরিক্ত কৌতুক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ থেকে নিষেধ করেছেন। তাছাড়া অতিরিক্ত হাসি-কৌতুক ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে দেয়।

যবানের আরেকটি খারাপ কাজ হলো কারো অগোচরে তার ব্যাপারে নিন্দাচর্চা করা। এটা খুবই গর্হিত কাজ। এটা গীবত। গীবতের ক্ষতি খুবই মারাত্মক। কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—

আর তোমরা একে অপরের গীবত করো নাতোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাকো।”[2]

তাহলে বোঝা গেল, গীবত করা নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার নামান্তর! অন্তরকে গীবতের প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখা ওয়াজিব। গীবত বা পরনিন্দা করা কবীরা গুনাহ।

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, চোগলখুর ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি পাবে না। তাই কূটনামি বা চোগলখুরি নামীমাহ থেকে যবান হেফাজত রাখা আবশ্যক। এটা তাকওয়া হাসিলেরও অন্যতম একটি উপায়।

এমনিভাবে গুপ্তাঙ্গসহ শুরুতে উল্লিখিত পাঁচটি অঙ্গকে যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে কন্ট্রোল করতে পারলে তাকওয়া হাসিলের পথ সুগম হবে।

আমরা তাকওয়া অর্জনের আলোচনায় ছিলাম। প্রকৃত তাকওয়া অর্জনকারী পরহেযগার তাঁরাই, যাঁরা আল্লাহ তাআলার বন্দেগীতে নিজেকে বিলীন করে দেন। আল্লাহ পাকের সর্বপ্রকার নাফরমানি থেকে সর্বদা আত্মরক্ষা করে চলেন। আনুগত্য ও ফরমাবরদারির চূড়ান্ত নযরানা পেশ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করেন।

সূফীগণের মতে পরিপূর্ণ তাকওয়া হলো, ফানা। অর্থাৎ নিজের জান আল্লাহ পাকের কাছে সঁপে দেওয়া। যাঁর যত বেশি ইলম, তাঁর তত বেশি তাকওয়া। যাঁর যত বেশি তাকওয়া তাঁর তত বেশি মারিফত।

ইলম হাসিল হয় উলামাদের সুহবত ও সান্নিধ্যে। উলামা তৈরির প্রতিষ্ঠান দ্বীনী মাদরাসা। তাই আমরা ইলম, উলামা ও মাদরাসার কদর করব। দুনিয়ায় শান্তি আসবে, অশান্তি দূর হবে। আখিরাতও হবে উজালা। ইনশাআল্লাহ।

[1] সূরা মুমিন : ১৯

[2] সূরা হুজুরাত : ১২

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT