ছয় মঞ্জিল প্রসঙ্গ : আলমে আজসাদ বা দুনিয়ার জগত (১০ম পর্ব)  

তাকওয়া অবলম্বনের তরিকা

যেকোনো সন্দেহযুক্ত জিনিস গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা এবং সন্দেহমুক্ত জিনিস বেছে নেওয়া হলো প্রকৃত তাকওয়া। যেমনটা তিরমিযী শরীফের রেওয়ায়েতে ইরশাদ করেছেন রাসূলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। নবীজি বলছেন- ‘যে জিনিসে তোমার সন্দেহ হয় তা ছেড়ে দিয়ে যে জিনিস সন্দেহমুক্ত তা-ই গ্রহণ করো।’[1]

তাকওয়ার অবস্থান হলো কলব বা হৃদয়ে। মুসলিম শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী, নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কলবের দিকে ইশারা করে বলেছেন, ‘তাকওয়া হলো এখানে।’

তাকওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে হযরত মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বাইহাকী শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাত ধরে কিছু দূর পথ চললেন এবং বলতে লাগলেন, ‘মুআয, আমি তোমাকে এই মর্মে ওসীয়ত করছি যে, তুমি আল্লাহ পাককে ভয় করবে, সত্য কথা বলবে, আমানত আদায় করবে, খেয়ানত করা থেকে বিরত থাকবে, ইয়াতীমদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবে, প্রতিবেশীদের যত্ন নেবে, রাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে, নরম ভাষায় কথা বলবে, বেশি করে সালাম দেবে, কুরআন শরীফের ইলম হাসিল করবে, আখিরাতকে পছন্দ করবে, আখিরাতের হিসাবকে ভয় করবে। আর এই মর্মে নিষেধ করছি যে, কোনো মুসলমানের দোষচর্চা করবে না, কোনো মিথ্যুককে সত্যবাদী সাব্যস্ত করবে না, সত্যবাদীকে মিথ্যুক ঠাওরাবে না, ন্যায়পরায়ণ নেতার নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকবে এবং কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে না। হে মুআয! আল্লাহ পাকের যিকির করো- প্রত্যেক গাছে ধারে, পাথরের কাছে। আর প্রত্যেক পাপ কাজের ওপর তাওবা করো, গোপন পাপের জন্য গোপনে তাওবা করো, প্রকাশ্য পাপের জন্য প্রকাশ্যে তাওবা।’

আব্বাজান কুতবে দাওরান হযরত বর্ণভী রহমতুল্লাহি আলাইহি’র একটি আমলের কথা মনে পড়ছে। তিনি নামাযে মাছনুন কেরাতের তিলাওয়াত খুব ভালোবাসতেন। জুমুআর দিন ফজরের নামাযে ইমাম সাহেব যদি প্রথম রাকাতে সূরা আলিফ লাম মীম আস-সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা দাহর তিলাওয়াত করতেন, তাহলে আব্বাজান খুবই খুশি হতেন। কেননা, এটা ছিল আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত আমল। বুখারী শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমুআর দিন ফজরের সালাতে প্রথম রাকাতে সূরা আলিফ লাম মীম আস-সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা দাহর তিলাওয়াত করতেন। সূরা দুটো খানিকটা দীর্ঘ হওয়ায় আমাদের গ্রামদেশের অনেক মসজিদে ইমাম সাহেবরা সাধারণত এই মাসনূন আমলটি করেন না সবসময়, তাই সফরে বা হজরে কোনো ইমাম সাহেব এই আমলটি করলে আব্বাজান অত্যধিক খুশি হতেন।

প্রসঙ্গ যখন উঠল, আসুন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাসনূন বা সুন্নত কেরাতসমূহ জেনে নিই। ফজর ও যুহরের নামাযে মাসনূন কেরাত হলো, তিওয়ালে মুফাসসাল অর্থাৎ সূরা হুজুরাত থেকে সূরা বুরূজ পর্যন্ত। সূরা বুরূজ থেকে সূরা বাইয়্যিনাহ বা লাম ইয়াকুন পর্যন্ত হলো আওসাতে মুফাসসাল, আসর ও ইশার নামাযে এর মধ্যকার যেকোনো সূরা মাসনূন কেরাত। আর মাগরিবের নামাযে হলো কিসারে মুফাসসাল, লাম ইয়াকুন থেকে সূরা নাস পর্যন্ত যেকোনো সূরা।

জুমুআর নামাযে প্রথম রাকাতে সূরা জুমুআ, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা মুনাফিকুন অথবা প্রথম রাকাতে সূরা আলা ও সূরা গাশিয়া পড়া সুন্নত।

জুমুআর নামাযের সুন্নত কেরাত বিষয়ে একটি স্মৃতি মনে পড়ল। ২০১৩ ঈসায়ীর রমযানে অধম ইতিকাফ করেছিলাম দারুল উলূম দেওবন্দের মসজিদে রশীদে। দেওবন্দের বুযুর্গানে দ্বীন এই অধম ও তার সাথীদেরকে অত্যধিক মহব্বত করেছিলেন এই সফরে। বিশেষত মাদানি খান্দানের মুহাব্বাত ও এহসান ভোলার মতো নয়। আল্লাহ তাআলা এই পরিবারের প্রতিজন সদস্যের ইহ ও পরকালীন দারাজাতকে আরও বুলন্দ করে দিন। তো, ইতিকাফের সময়ে এক জুমুআয় দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ আমাকে জুমুআর ইমামতির জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন। বুযুর্গানে দ্বীনের নির্দেশ পালনার্থে বান্দা জুমুআর খুতবা দিয়ে ইমামতির জন্য দাঁড়ালাম। সেদিনের জামাতে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরতুল আল্লাম আরশাদ মাদানী ছাহেব দা. বা.-ও শরীক ছিলেন। আমি নামাযে দাঁড়িয়ে মাসনুন কেরাতের লেহাজ করি নাই। অন্য সূরা দিয়ে নামায পড়ালাম। নামাযান্তে হযরত আরশাদ মাদানী ছাহেব দা. বা. আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আপনি মাসনুন কেরাত কেন ছাড়লেন! আজ শায়খুল ইসলাম (উনার মুহতারাম আব্বাজান আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) যিন্দা থাকলে আপনার খবর ছিল কিন্তু! আর কখনোই সুন্নাত কেরাত ছাড়বেন না!’

আলহামদুলিল্লাহ! আহলে দিল বুযুর্গের এই ধমক আমার অনেক কাজে লেগেছে। এখান থেকে আমি অনেক সবক হাসিল করতে পেরেছি। দেখুন, বুযুর্গদের আমল! একটি সুন্নতের ব্যাপারেও তাঁরা কত চৌকান্না থাকেন! আল্লাহ তাআলা এ সমস্ত আহলে দিল বুযুর্গের রূহানী ফয়েয ও বরকত দ্বারা আমাদেরকে মণ্ডিত করুন। আমীন।

তো, তাকওয়ার ব্যাপারে বলছিলাম। তাকওয়ার আরেকটি দিক হলো, এটা আল্লাহর ওলী হবার বিশেষ গুণের একটি। আল্লাহর ওলী হতে গেলে বান্দার মধ্যে দুটি গুণ বিদ্যমান থাকতে হয়। ১. কামিল ঈমান ২. কামিল তাকওয়া। ঈমান যদি কারও মধ্যে পোক্ত থাকে আর আল্লাহ তাআলাকে যদি সে ভয় করার মতো ভয় করতে পারে তাহলে আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হওয়ার জন্য তার আর কিছু করা লাগবে না। কেননা, আল্লাহকে ভয় করলে সে কোনো গুনাহের কাজে লিপ্ত হবে না, আল্লাহকে ভয় করলে সে ফরয ওয়াজিব সুন্নত আমল ত্যাগ করার সাহস পাবে না। আর এই পর্যায়ে যে ব্যক্তি পৌঁছে যায়, আল্লাহ তাআলার ওলীগণের তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হওয়ার আশা আমরা করতেই পারি।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ ১৩টি বছর মক্কার যমীনে কাফিরদের সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করার পর যখন হিজরত করে মদীনায় তাশরিফ রাখেন, মদীনা প্রবেশের আগে অদূরের কুবা পল্লিতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে নিজের পবিত্র হাতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটির নাম ছিল মসজিদুত তাকওয়া। তাকওয়ার মসজিদ। প্রথম জুমুআয় যে খুতবাটি প্রদান করেছিলেন সেই খুতবার নামও ছিল তাকওয়ার খুতবা। তাকওয়ার ওপরই তিনি মসজিদের বুনিয়াদ গড়েছিলেন, খুতবায় কুবাবাসীদের উদ্দেশ্যে তাকওয়ারই বয়ান করেছিলেন। খুতবার সারাংশ ছিল এমন- আমি তোমাদেরকে তাকওয়া তথা খোদাভীতির নসীহত করছি। কেননা, এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে নসীহত করার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বিষয় হলো, তাকে আখিরাতের প্রতি মনোযোগী করা এবং তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া। তাকওয়া অবলম্বনের নসীহত করার চেয়ে উত্তম কোনো নসীহত নাই। তাকওয়া হলো পরকালের কঠিন সময়ে বড় সাহায্যকারী। যারা আল্লাহ পাককে ভয় করে, তাদের গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়। তাকওয়ার গুণ যে বান্দা অর্জন করে নিলো সে কামিয়াব। তাকওয়া অবলম্বনের দ্বারা আল্লাহ পাকের গোস্বা গজব নারাজি ও শাস্তি থেকে বাঁচা যায়। তাকওয়ার বদৌলতে অন্ধকার চেহারা আলোকিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও দারাজাত বুলন্দির মাধ্যমও হলো এই তাকওয়া।

[1] তিরমিযী : ২৫১৮

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT