আলম আরবি শব্দ, যার অর্থ জগৎ। আরওয়াহ রূহের বহুবচন, যার অর্থ আত্মাসমূহ। ‘রূহ’ শব্দটি অভিধান, বাকপদ্ধতি এবং পবিত্র কুরআনে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। রূহের প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত অর্থ হলো- প্রাণ, যার বদৌলতে জীবন কায়েম রয়েছে। প্রচলিত অর্থে আলমে আরওয়াহ বলতে রুহের বাসস্থানকে বুঝায়।
পরিভাষায় ‘রূহ’ শব্দের প্রসিদ্ধ অর্থ হলো, এমন বস্তু যার উপর কোনো প্রাণীর জীবন নির্ভরশীল থাকে।
রূহের অস্তিত্ব সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনে একাধিক আয়াত বিবৃত হয়েছে। অন্যান্য আসমানী কিতাবেও রূহের অস্তিত্বের বিবরণ এসেছে। তবে এর আকার-আকৃতি ও ধরন সম্পর্কে আসমানী কোনো কিতাবেই কোনো বর্ণনা নেই। আলমে আরওয়াহ বা রূহজগতে রূহের অবস্থান কতকাল ছিল, এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা তাঁর পেয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন—
“আর আপনাকে তারা (ইহুদীরা) জিজ্ঞেস করে রূহ সম্পর্কে। আপনি বলুন, রূহ হচ্ছে আমার রবের একটি হুকুম মাত্র।” (সূরা বনী ইসরাঈল : ৮৫)
রূহের নিয়ন্ত্রণ একমাত্র বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ তাআলার হাতে। এই রূহকে আল্লাহ তাআলা যখন যেখানে যতদিন অবস্থান করাতে চান, তাকে সেভাবেই অবস্থান করতে হয়। আল্লাহর হুকুম ব্যতিরেকে একচুলও এদিক-সেদিক হবার ক্ষমতা রূহের নেই।
আলমে আরওয়াহে অবস্থানের পর একপর্যায়ে রূহ মানবদেহে প্রবেশের অনুমতি পায়। মানবদেহে সে যতদিন অবস্থান করে ততদিনই মানুষকে জীবিত বলা হয়। আর রূহ বের হয়ে গেলে মানুষকে বলা হয় মৃত। মানবদেহে রূহের এই অবস্থানের সময়সীমা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। এই সময়সীমার বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটবে না। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে—
“(মানবদেহ থেকে রূহ বের হওয়ার) সময় (অর্থাৎ মৃত্যু) যখন চলে আসবে, তখন একমুহূর্তও এদিক–সেদিক হবে না।”( সূরা আরাফ : ৩৪)
দেহ থেকে রূহ বের হয়ে পড়লে দৈহিক শক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। রূহের সম্পর্ক তখন ইহজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে সে তখন পরজগতের অনেক দৃশ্য দেখতে পায়। এদিকে রূহবিহীন যে দেহ পড়ে থাকে দুনিয়ায়, সেটাকে আর মানুষ বলা হয় না, বলা হয় ‘লাশ’।
একটি স্বাভাবিক নিয়ম হলো, সকল বিদ্যমান (মওজুদ) বস্তু দেখা যায়; আর রূহও যেহেতু একটি বিদ্যমান বা মওজুদ বস্তু, তাই রূহকেও দেখা সম্ভব। কিন্তু আমরা এটাকে দেখতে পারি না বলে এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
জীবন-চাকা সচল থাকে, যদি তার সাথে রূহ সংযুক্ত থাকে। রূহ চলে গেলে জীবন-চাকা অচল হয়ে পড়ে। দেহ ও রূহ, এ দুয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধ হচ্ছে বন্ধুর মতো। পরস্পরের আন্তরিক সহযোগিতায় তারা পথ চলে। অথবা রূহ ও দেহের সম্পর্ক ধরতে পারেন গাড়ি ও যাত্রীর মতো। যাত্রাপথে তাদের একে অন্যের সহযোগিতায়ই কেবল এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
রূহ এমন এক বস্তু, যার ক্ষুধাও নেই, পিপাসাও নেই; তাই চলার পথে তার খানাপিনার দরকার পড়ে না। রূহ যখন দেহের সাথে সংযুক্ত হয়, তখন তার প্রকৃত মালিক ও মালিকের গুণাবলির পরিচয় লাভের প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করে। একসময় তার এ আকাঙ্ক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এমনকি আপন রবের পরিচয় লাভ ও মুহাব্বাতে সে পাগলপারা হয়ে ওঠে। রূহের এ অবস্থা এজন্য হয়, কারণ, ইতিপূর্বে সে তার রবের দর্শন লাভ করেছে, রবের সাথে কথাবার্তা বলেছে, রব তাঁকে আপন দয়া ও মেহেরবানিগুণে মুহাব্বাত ও ভালোবাসার মাধ্যম দেহ-শরীর দান করেছেন। সে যেন রবের ইবাদাত করতে পারে, এজন্য রব তাকে দেহের মুহতাজ (মুখাপেক্ষী) বানিয়েছেন। এ ছাড়া দেহ পরিচালনার জন্য অপরাপর জিনিসেরও মুহতাজ বানিয়েছেন তাকে। যেন এসবের মাধ্যমে সে আল্লাহ তাআলার সিফাত ও মারিফাত হাসিল করতে পারে। যেমন : খানাপিনার প্রয়োজন পূর্ণ করে সে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করবে। পানি পান করে সে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা জ্ঞাপন করবে।
রূহের দীদারে এলাহী
রূহজগতে আদি-পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামের মেরুদণ্ড থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকারে সমস্ত মানুষকে বের করে আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের রব নই?’ তখন সকল মানুষ সমস্বরে জবাব দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব।’
এই প্রশ্নোত্তর-পর্বেই আল্লাহ তাআলার দীদার বা সাক্ষাৎ লাভ হয় সকল মানুষের। আর এখানে সবার আগে প্রশ্নের জবাব যিনি দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এই প্রশ্নোত্তরের সময়েই সকল মানবাত্মা আল্লাহ তাআলাকে দেখেছে এবং তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে। এই কথোপকথন ও দর্শনে মানবাত্মায় আল্লাহ তাআলার মারিফাত ও মুহাব্বাতের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। ফলে সকল মানবাত্মা রূহ জগত থেকে হিজরত করার জোরালো আবদার উত্থাপন করে। তাদের এ আবদারের নিমিত্তে আল্লাহ তাআলা ‘আলাতে মুহাব্বাত’ (দেহ) দিয়ে তাদেরকে ইহজগতে প্রেরণ করেন। মোটকথা, মানবাত্মা বা রূহের ইহজগতে আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ‘তাআল্লুক মাআল্লাহ’ বা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং আল্লাহ তাআলার মারিফাত বা পরিচয় লাভ করা।
রূহ ও দেহের সম্পর্ক
রূহ ও দেহের সম্পর্কের পাঁচ অবস্থা—
১. মাতৃগর্ভে।
২. ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর। এই অবস্থায় রূহ ও দেহ উভয়ে একই সঙ্গে অবস্থান করে।
৩. ঘুমের অবস্থায়। এ অবস্থায় রূহ শরীর থেকে একপ্রকার আলাদা হয়, কিন্তু উভয়ের সম্পর্ক মজবুত থাকে।
৪. মৃত্যুর পর কবরে। এই অবস্থায় উভয়ের সম্পর্ক দুর্বল থাকে।
৫. হাশরে। এ অবস্থায় রূহের সম্পর্ক দেহের সঙ্গে খুব মজবুত থাকে। জাহান্নামী ব্যক্তির রূহ দেহসহ জাহান্নামে থাকবে আর জান্নাতী ব্যক্তির রূহ দেহসহ জান্নাতে থাকবে।
কলব, রূহ, নফস : মানবদেহে কোনটার গোপনীয় অবস্থান কোথায়?
কলব : কলবের অবস্থান দেহের বাম স্তনের নিচে।
রূহ : রূহের অবস্থান ডান স্তনের নিচে।
নফস : নফসের অবস্থান নাভির নিচে। সাধনা ও সংযত-জীবনযাপন নফসকে একেবারে মেরে ফেলতে পারে না, তবে সাধনার মাধ্যমে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখলে আত্মা বা রূহ সতেজ থাকে।
দেহ ত্যাগ করে রূহ কোথায় যায়?
দেহ ত্যাগ করে রূহ কোথায় যায়, এ মর্মে প্রশ্ন করা হলে সিদ্দীকে আকবর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রূহ সাতটি স্থানে চলে যায়। ১. সমস্ত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালামের রূহ ‘জান্নাতু আদনে’। ২. উলামায়ে কেরামের রূহ ‘জান্নাতুল ফিরদাউসে’। ৩. নেককার মুমিনের রূহ ‘ইল্লীন’ নামক স্থানে। ৪. শহীদগণের রূহ জান্নাতে উড়ন্ত অবস্থায় বিচরণ করতে থাকে। ৫. গুনাহগার মুমিনের রূহ আকাশে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। ৬. মুমিনদের শিশু-সন্তানের রূহ কস্তুরীর পাহাড়ে অবস্থান করে। ৭. আর বেদ্বীন কাফিরের রূহ চলে যায় ‘সিজ্জীন’ নামক স্থানে।
সুতরাং আলমে আরওয়াহ বা রূহজগতে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে আমরা যে অঙ্গীকার করে এসেছি, সেই অঙ্গীকার পূরণে জীবন-যৌবনের সবটুকু সময় উজাড় করে আল্লাহর মারিফাত লাভে মৃত্যু পর্যন্ত ইবাদাত-বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা আমাদের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।
চলবে…