ছয় মঞ্জিল প্রসঙ্গ : আলমে আরহাম বা মাতৃগর্ভ (২য় পর্ব)

আলমে আরহামে মানবসন্তানের অবস্থানের সর্বোচ্চ সময়সীমা

আলমে আরহাম বা মাতৃগর্ভে মানবসন্তানের অবস্থানের সর্বোচ্চ সময়সীমা কত দিন হবে তা নির্ধারিত নয়। স্বাভাবিকভাবে ৯ থেকে ১০ মাসের মধ্যেই অধিকাংশ সন্তান ভূমিষ্ট হয়। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। মাতৃগর্ভে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় অবস্থান করে যাঁরা ঝলমলে পৃথিবীর আলো-বাতাসে শুভাগমন করেছিলেন, তাঁদের চারজনের বিবরণ পেশ করেছেন আল্লামা কামালউদ্দীন দিময়ারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ কিতাব হায়াতুল হায়ওয়ানে। সেই চারজন হলেন—

১. আল্লামা সুফিয়ান হাইয়্যান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি চার বছর সময়কাল মায়ের গর্ভে ছিলেন।

২. মুহাম্মাদ ইবনু হাসান জাহ্বাক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ১৬ মাস মায়ের গর্ভে ছিলেন।

৩. ইয়াহইয়া ইবনু আলী ইবনি জাবির বাগাভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি দুই বছর সময়কাল মায়ের গর্ভে ছিলেন।

৪. হযরত সুলাইমান জাহ্বাক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি দুই বছর মাতৃগর্ভে ছিলেন।

গর্ভবতী নারীদের ব্যাপারে স্বামীদের করণীয়

  • তাঁদের মনে কোনো দুঃখ না দেওয়া।
  • কোনো কষ্ট না দেওয়া।
  • গর্ভকালীন সময়ে তাঁদেরকে কোনো ভয়ভীতি না দেখানো।
  • সদাচার ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে গর্ভবতীর মন প্রফুল্ল রাখা।
  • মন প্রফুল্ল রাখতে তাঁদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে খোশগল্প করা।
  • গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে মাঝেমধ্যে একই প্লেটে খানা খাওয়া।

স্বাভাবিক সময়েও স্ত্রীদের সাথে এরূপ ভালোবাসা-সুলভ আচরণ করা সুন্নাতে নববীর অন্তর্ভুক্ত। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই প্লেটে খাবার খেতেন। আম্মাজান আয়শা যে হাড্ডি খেতেন নবীজি সেই হাড্ডিই আবার চিবিয়ে খেতেন। আম্মাজান গ্লাসের যে অংশে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন, নবীজিও সে অংশে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন। কেবল আম্মাজান আয়েশাই নন, নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্রতমা অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গেও একই প্লেটে খাবার খেতেন, এমনকি তাঁদের মুখে খাবারের লুকমাও তুলে দিতেন। নবীজি বলেন, ‘স্ত্রীদের মুখে খাবারের লুকমা তুলে দেওয়াতেও সাদাকার সওয়াব অর্জিত হয়।’

গর্ভস্থ সন্তান নেককার হওয়ার আমলসমূহ

  • গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়ের চলাফেরায় পূর্ণাঙ্গ শরয়ী পর্দা বজায় রাখা।
  • গর্ভকালে আচার-ব্যবহারে স্বামীকে খুশি রাখা।
  • বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করা।
  • বেশি বেশি দরূদ শরীফের আমল করা।
  • পবিত্র কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত বেশি বেশি করা।

গর্ভস্থ সন্তান নেককার হওয়ার জন্য মা-বাবা উভয়েই আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার দুআ আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। এ বিষয়ে একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গর্ভকালে মা-বাবার নেক ও বদ আমলের প্রভাব গর্ভস্থ সন্তানের উপর পড়ে।

গর্ভবতী মায়ের মর্যাদা ও ফযীলত

১. গর্ভবতী মা দিনে নফল রোযা রাখার সওয়াব লাভ করবেন।

২. রাতে নফল নামাযের সওয়াব লাভ করবেন।[1]

৩. গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবেন।[2]

গর্ভবতী মায়ের আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা

এ বিষয়টি তো অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, শুধু আল্লাহ তাআলা এতে সক্ষম যে, তিনি তাকে যা হওয়ার তাই বানিয়েছেন। সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে তাকে নির্বাচন করেছেন। তাই সবসময় বেশি বেশি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা, যাতে আল্লাহর এই কৃতজ্ঞতা আদায়ের প্রভাব আগত বাচ্চার মধ্যেও স্থানান্তরিত হয়। পাশাপাশি নিয়তকেও খালিস ও পরিশুদ্ধ রাখা।

আরও কিছু করণীয় ও বর্জনীয়

একজন সত্যিকার মুসলিম নারী এ সময়টাকে বিপদ-মুসীবত মনে করে না। বরং তাদের কর্তব্য হলো, এ কষ্ট-যাতনাকে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়া। এ সময়টাতে নারী আল্লাহর বিশেষ রহমতে ডুবে থাকেন। এ সময়ের ইবাদাত অন্য সময়ের ইবাদাতের চেয়ে অনেক বেশি দামি ও মূল্যবান। এ জন্য সবসময় আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকা। নামাযের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। যত বেশি সম্ভব কুরআন তিলাওয়াত করা। সবসময় পবিত্র অবস্থায় থাকা, ওযু সহকারে থাকা। এগুলো শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির কারণ হবে।

এ ছাড়া মা হতে যাওয়া নারীকে ধৈর্য ও অল্পেতুষ্টির পরিচয় দিতে হবে। যেসব খারাপ অভ্যাস মানুষের জীবনকে নিকৃষ্ট করে ফেলে, যেমন : হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, আত্মগরিমা ও মিথ্যা-এসব থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় কাজ পরিহার করা। অত্যধিক প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়া। সবসময় ইবাদাতে জড়িয়ে থাকা। এ সব কাজে পেটে ধারণ করা অনাগত সন্তানও অংশগ্রহণ করে। আর আল্লাহর সামনে মায়ের প্রত্যেকটা আমলের সাক্ষীও হবে সে।

সন্তান সহজে খালাস হওয়ার বিশেষ আমল

গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হলে বিসমিল্লাহ-সহকারে সূরা ইনশিকাকের প্রথম চার আয়াত ৬৩ বার তিলাওয়াত করা। পূর্ণ ইয়াকীন ও বিশ্বাসের সাথে এই আমল চালিয়ে গেলে ইনশাআল্লাহ সন্তান সহজে খালাস হবে।

প্রাসঙ্গিক কয়েকটি মাসআলা

১. গর্ভাশয় ভাড়া দেওয়া ও নেওয়া হারাম।

২. টেস্টটিউভ-পদ্ধতি অবলম্বনে বাচ্চা নেওয়া হারাম।

৩. গর্ভস্থ সন্তানের বয়স ১২০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর গর্ভপাত করা হারাম। গর্ভের মেয়াদ ৪ মাস পূর্ণ হওয়ার পর গর্ভপাত করলে জীবন্ত মানুষ হত্যার গুনাহ হবে।

৪. গর্ভবতী মা মারা যাওয়ার পর গর্ভস্থ সন্তানের নড়াচড়া অনুভব করলে বাচ্চা বের করে নিতে হবে।

সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বে মাবাবার করণীয়

সূরা আলে ইমরানের ৩২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয় তার নাম রেখেছি মারইয়াম (আবিদা) এবং নিশ্চয় আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে তোমার আশ্রয়ে দিচ্ছি[3]এটা ছিল মরিয়ম আলাইহাস সালামের মা হান্নার দুআ। তাই প্রত্যেক মা-বাবার করণীয় হলো সন্তানের জন্য দুআ করা। কেননা সন্তানের পক্ষে মা-বাবার দুআ আল্লাহর নিকট মকবুল। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী, হযরত হাসান ও হুসাইনের জন্য দুআ করেছিলেন। একটি হাদীসে রাসূল বলেন, ‘এমন কোনো মানবসন্তান নেই, ভূমিষ্ট হওয়ার সময় যাকে শয়তান খোঁচা মারেনি। ফলে সে চিৎকার দিয়ে ওঠে।’ এজন্য মা-বাবা সন্তানের জন্য এই দুআ করবে যে, আল্লাহ তাআলা যেন স্বীয় সন্তানকে সকল প্রকার বিপদাপদ ও শয়তানের যাবতীয় কুমন্ত্রণা থেকে হেফাজত করেন।

[1] তাবরানী, খণ্ড : ৭; পৃষ্ঠা : ২০

[2] আবু দাউদ : ৩১১১

[3] সূরা আল ইমরান : ৩২

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT