ছয় মঞ্জিল প্রসঙ্গ : আলমে আরহাম বা মাতৃগর্ভ (১ম পর্ব)

আরহাম শব্দটি বহুবচন, একবচনে রিহম ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ গর্ভ, গর্ভাশয়, জরায়ু, আত্মীয়তার সম্পর্ক ইত্যাদি।

মায়ের গর্ভে নূরের তৈরি ফিরিশতা পাঠিয়ে সেখানেও রুবুবিয়্যাতের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত করানো হয়। ইয়া রাব্বী নুতফা, ইয়া রাব্বী আলাক্বা, ইয়া রাব্বী মুযগাহ। মায়ের গর্ভে ১২০ দিন পূর্ণ হলে মানবসন্তানের দেহে রূহ দেয়া হয়। এরপর থেকে নাভীর মাধ্যমে মায়ের নাপাক রক্ত সন্তানের খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। এটা কেবল আল্লাহ পাকের কুদরতের নিদর্শন।

আলমে আরহাম তথা মানবজীবনের দ্বিতীয় মানযিল সকল মানুষকেই অতিক্রম করতে হয়েছে। ব্যতিক্রম ছিলেন দুজন। আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম। শুধুমাত্র এই দুইজনই মাতৃগর্ভে অবস্থান করা ব্যতীত সরাসরি জান্নাত থেকে পৃথিবীতে এসেছিলেন। প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে ভারতের সরন্দ্বীপে (শ্রীলংকা) ও মা হাওয়া আলাইহাস সালামকে জেদ্দায় (সৌদি আরবে) অবতরণ করানো হয়।

 

মানব সৃষ্টির ইতিকথা

মানব সৃষ্টির তত্ত্ব বর্ণনায় আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলেন—

তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একই ব্যক্তি থেকে, এরপর তিনি তার জোড়ও সৃষ্টি করেছেন দেহ থেকেই, আর তোমাদের জন্যে চতুষ্পদ জন্তু থেকে আট প্রকারের নরনারী সৃষ্টি করেছেন তিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে এক অবস্থার পর অন্য অবস্থায় তিনটি অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন তিনিই আল্লাহ, তিনি তোমাদের প্রতিপালক, সার্বভৌমত্ব শুধু তাঁরই, তিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই অতএব, তোমরা বিমুখ হয়ে কোথায় চলেছ?”[1]

এখানে মানব সৃষ্টির ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের একটি বিস্ময়কর কুদরত ও হিকমতের কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ পাকের সৃষ্টির নৈপুণ্যের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো স্বয়ং মানুষের অস্তিত্ব; তার জীবন।

মানুষ যদি তার সৃষ্টির ক্রমধারার প্রতি চিন্তা ও গবেষণা করে তাহলে আল্লাহ পাকের মহান দরবারে সর্বক্ষণ কৃতজ্ঞাবনত থাকাই তার একান্ত কর্তব্য বলে মনে করবে।

পাশাপাশি আল্লাহ পাক আত্মবিস্মৃত মানুষকে মানব সৃষ্টির রহস্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালনের এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়েছেন-ওহে আত্মভোলা মানুষ! তিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে এক অবস্থার পর অন্য অবস্থায় সৃষ্টি করেন, আর তাতে বিভিন্ন সময় একাধিক পরিবর্তন সূচিত হয়, আর তা হয় আল্লাহ পাকের বিশেষ কুদরতেই।

প্রথমত শুক্রবিন্দু, আর তা থেকে আল্লাহ পাক রক্তপিণ্ড তৈরি করেন, অতঃপর তার ক্রম বিকাশ ঘটে মাংস পিণ্ডের মাধ্যমে, এরপর তাতে অস্থি বর্ণ প্রভৃতি সৃষ্টি করা হয়। এরপর তিনটি অন্ধকারের মধ্যে মানুষের সৃষ্টিকর্ম সুসম্পন্ন করেন। কেননা মানব সন্তান আল্লাহ পাকের কুদরতে একটি ঝিল্লীর মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। আর তা জরায়ুতে স্থাপিত হয়। এবং তা মাতৃগর্ভের নিম্নদেশে থাকে।

তিনটি অন্ধকার হলো— (১) পেট (২) জরায়ু (৩) ঝিল্লী- যা প্রসবকালে বের হয়ে আসে।

সুদীর্ঘ নয়মাস যাবত মানব সন্তানকে এই তিনটি অন্ধকার অতিক্রম করে আল্লাহ পাকের হুকুমে পৃথিবীর আলো দেখতে হয়। এভাবে আল্লাহ পাক তাকে মাতৃগর্ভ থেকে বের করে আনেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক কুরআনে ইরশাদ করেছেন—

আর আল্লাহ পাক বের করে এনেছেন তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে, তখন তোমরা কিছুই জানতে না এরপর আল্লাহ পাক দান করেছেন তোমাদেরকে শ্রবণশক্তি, দর্শনশক্তি এবং (উপলব্ধি করার জন্যে) অন্তর, হয়তো তোমরা শোকর গোজার হবে[2]

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন, ‘মানব সৃষ্টির ক্রমবিকাশের যে ধারা এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, তাতে আল্লাহ পাকের দুটি বিস্ময়কর গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটি হলো, আল্লাহ পাকের সর্বময় ক্ষমতা এবং বিস্ময়কর কুদরত ও হিকমতের। দ্বিতীয়টি হলো, পরিপূর্ণ ইলমের।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা কীভাবে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন তার এক ধারাবাহিক বিবরণ স্থান পেয়েছে সূরা মুমিনূনে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান থেকে এরপর আমি তাকে শুক্রবিন্দু রূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ স্থানেঅতঃপর ওই বিন্দুকে আমি জমাট রক্তে পরিণত করি, পুনরায় এই জমাট রক্তকে গোশত পিণ্ডে রূপান্তরিত করি, পরে পিণ্ড থেকে অস্থি তৈরি করি আর অস্থিকে ঢেকে দিই গোশত দ্বারা এরপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি অতএব, সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ পাক, তিনি কত মহান।”[3]

এখানেও আত্মবিস্মৃত মানুষকে আল্লাহ পাক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হে বিভ্রান্ত পথভ্রষ্ট মানুষ! এই সত্য তোমরা ভুলে যেয়ো না যে তোমাকে আল্লাহ পাক অপবিত্র পানি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে সংকলিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান-‘মানুষ তার সৃষ্টির ক্রমধারার প্রথম চল্লিশ দিন মায়ের গর্ভে বীর্য রূপে অবস্থান করে, এরপর দ্বিতীয় চল্লিশ দিন জমাট রক্তপিণ্ডরূপে এবং তৃতীয় চল্লিশ দিন মাংসপিণ্ডরূপে অবস্থান করে।’

এখানে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আল্লাহ পাক তো একবারেই মানুষকে সৃষ্টি করতে পারেন। তাহলে বিভিন্ন পর্যায়ে কেন সৃষ্টির প্রক্রিয়া গ্রহণ করলেন? এ প্রশ্নের জবাবে মুহাদ্দিসীনে কেরাম কয়েকটি হিকমাত বর্ণনা করেছেন।

১. মানুষ যাতে তার জীবনযাপনের কর্মসমূহ পর্যায়ক্রমে বিন্যস্তভাবে সম্পন্ন করে।

২. মানুষের মধ্যে যাতে কোনো তাকাব্বুরি (অহংকার) না থাকে।

৩. যাতে মায়ের কষ্ট কম হয়।

৪. আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতের বহিঃপ্রকাশ হয়।

মায়ের গর্ভে সন্তান ঊর্ধ্বে দশ মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পারে, আর নিম্নে পূর্ণ ছয় মাস। ছয় মাসের পূর্বে কোনো সুস্থ সন্তান জন্ম নিতে পারে না।

দুররে মুখতার কিতাবে এ মর্মে উল্লেখ আছে-সন্তান তার মায়ের গর্ভে দশ মাসের অধিক সময় থাকাটা কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও তা অসম্ভব নয়। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সমর্থনযোগ্য।

আমার জানা মতে এ বিষয়ের একটি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরছি-নবীগঞ্জ নূরগাঁওয়ের আমার শ্বশুরালয়ের এক ভদ্রমহিলা গর্ভকালীন সময়ে প্রায়ই তাঁর অবস্থা আমাকে শুনাতেন-তাঁর গর্ভস্থ সন্তান দশ মাসের অধিক সময় হয়ে গেছে। পেরেশান ভাব নিয়ে দুআ চাইতেন। আমি তাঁকে বলি, সবর করতে, আল্লাহ পাকের ওপর ভরসা রাখতে এবং সাহায্য চেয়ে দুআ করতে। ইনশাআল্লাহ সময়মতো প্রসব হবে। আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে আঠারো মাস পূর্ণ হলে বিনা অপারেশনে ওই মহিলার এক পুত্রসন্তান সুস্থ অবস্থায় জন্ম হয়। ওই মা ও সন্তান এখনো জীবিত আছেন। এ ঘটনা আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে।

[1] সূরা যুমার : ৬

[2] সূরা আন-নাহাল : ৭৮

[3] সূরা মুমিনূন : ১২-১৪

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT