حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ حَدَّثَنَا أَبُو عَامِرٍ الْعَقَدِيُّ، قَالَ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ بِلاَلٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم قَالَ “الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ”.
হাদীসের তরজমা :
হযরত আবু হুরাইরাহ রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ঈমানের ষাটেরও অধিক শাখা আছে। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি শাখা।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ০৯)
ঈমানের পরিচয় :
ঈমান আরবী শব্দ। আরবী ‘আমনুন’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। শব্দটির মূল অর্থ- বিশ্বাস করা, স্বীকৃতি দেওয়া এবং বিশ্বস্ততা বা হৃদয়ের স্থিতি। এছাড়া আনুগত্য করা, শান্তি, নিরাপত্তা, অবনত হওয়া এবং আস্থা অর্থেও ঈমান শব্দটি ব্যবহৃত হয়। (মুয়জামুল মাকায়িসিল লুগাহ, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১৩৩)
ঈমান মূলত ছয়টি বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর সেগুলো হলো- ১. আল্লাহ। ২. ফেরেশতা। ৩. আসমানী কিতাব। ৪. নবী-রাসূল। ৫. শেষ দিবস ও পুনরুত্থান। ৬. ভাগ্যের ভালোমন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ঈমানের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমামগণের বিভিন্নধর্মী সংজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। সেগুলো হলো-
১. ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতিই হলো ঈমান’।
২. ইমাম গাজালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনীত সকল বিধি-বিধানসহ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাই হচ্ছে ঈমান’।
৩. ইমাম শাফেয়ী, মালেক ও আহমদ ইবনে হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে, ‘অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং আরকানসমূহ (ইসলামের বিধি-বিধান) কাজে পরিণত করার নাম ঈমান’।
ঈমানের শাখা-প্রশাখার বিবরণ :
উল্লিখিত হাদীসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, ঈমানের ৬০-এরও অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। অন্য হাদীসে এসেছে ৭০-এরও অধিক।
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ঈমানের মোট ৭৯টি শাখার কথা উল্লেখ করেছেন। (আল-ইহসান ফি তাকরিরি ইবনে হিব্বান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৮৭)
আসল কথা হলো-بِضْعٌ বলতে ৩ থেকে ৯ পর্যন্ত বুঝায়। সে হিসাবে সর্বোচ্চ ৬৯ বা ৭৯টি হয়। এখানে সংখ্যা দ্বারা মূলত সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যা বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং বোঝানো উদ্দেশ্য সংখ্যাধিক্য। অর্থাৎ ঈমানের অনেকগুলো শাখা আছে। সুতরাং ষাট বা সত্তরের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা মেলানোর চেষ্টা বৃথা।
উল্লিখিত হাদীস থেকে আরোও বুঝা যায়, ঈমানের সকল শাখা-প্রশাখা সমান নয়, এগুলোর মধ্যে উচু-নীচু স্তরভেদ রয়েছে। মুহাদ্দিসীনে কেরাম বিভিন্নভাবে ঐ শাখাগুলো গণনা করেছেন। ক্বাযী আয়ায সেগুলোকে সংক্ষেপে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
(১) হৃদয়ের আমল। যা আকীদা-বিশ্বাস ও নিয়তের সাথে সংশ্লিষ্ট। এগুলো মোট ২৪টি। যেমন- আল্লাহর উপর বিশ্বাস। যিনি স্বীয় সত্তা ও গুণাবলীতে অনন্য এবং যা অন্য কারো সাথে তুলনীয় নয়। ফিরিশতাদের উপর বিশ্বাস ও অন্যান্য অদৃশ্য বিষয়ক জ্ঞান।
(২) যবানের আমল। এগুলো মোট ৭টি। যেমন- তাওহীদের স্বীকৃতি, কুরআন তেলাওয়াত, ইলম শেখা ও শিখানো, দুআ পাঠ ইত্যাদি।
(৩) দৈহিক আমল। এগুলো মোট ৩৮টি। যেমন- পবিত্রতা অর্জন, সালাত, সিয়াম, যাকাত, হজ, পর্দা করা, সাদাকা করা, পিতা-মাতার সেবা করা, পরিবার পালন করা, নেতার আনুগত্য করা, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করা, দন্ডবিধি কায়েম করা, জিহাদ করা, বাজে কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা ইত্যাদি। (ফাতহুলবারী, ০৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
ঈমানের শাখা-প্রশাখা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ঐসব কর্ম ও আচরণ এবং বাহ্যিক ও আত্মিক এমন অবস্থা ও গুণাবলী যা ঈমানের সূত্র ধরে মুমিনের মাঝে অর্জিত হওয়া কাম্য।
ঈমানের সর্বোচ্চ শাখা :
বুখারী শরীফের অনত্র বর্ণীত হয়েছে, ঈমানের সর্বোচ্চ শাখা হলো- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
অর্থাৎ, এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, কোনো উপাস্য নেই। তিনি একক, অদ্বিতীয়। তিনি সব পারেন, সব করেন। সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই অধীন। তিনি সব ধরনের দুর্বলতা, ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। সামান্য থেকে সামান্যতম বিষয়েও সবাই তার মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন- এমন বিশ্বাস লালন করা।
সেই সাথে এ কথাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা এবং মেনে নেয়া, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তিনি সর্বশেষ নবী। মানুষের হেদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ পয়গম্বর। তাঁর পরে আর কোনো নবী অথবা রাসূল আসবেন না।
ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা :
শুয়াবুল ঈমান সংক্রান্ত অন্য হাদীসে ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা বলা হয়েছে- রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করে দেওয়াকে। আপাতদৃষ্টিতে এ আমলটি অতি সামান্য মনে হলেও বাস্তবতায় এটি অনেক বড়। কেননা এ কাজটি করা হয় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ থেকে। আল্লাহর বান্দাগণ এ পথে যাতায়াত করতে গিয়ে কষ্ট পেতে পারে, সে চিন্তা থেকেই একজন মুমিন কষ্টদায়ক বস্তুটি সরিয়ে ফেলে। অর্থাৎ সে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে শিক্ষাই আমাদের দান করেছেন। তিনি এক হাদীসে বলেন-
المسلمون كرجل واحد، إن اشتكى عينه اشتكى كله، وإن اشتكى رأسه اشتكى كله
‘মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তির মত, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম, হাদীসক্রম : ৬৫৮৯)
এর দ্বারা বোঝা গেল অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করা প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক। সুতরাং প্রকৃত মুমিন রাস্তায় কষ্টদায়ক বস্তু দেখলে অবশ্যই তা দূর করবে, যাতে অন্য মুসলিম কষ্ট না পায়।
লজ্জাও ঈমানের শাখা :
হাদীসে ঈমানের শাখাসমূহের মধ্য থেকে কেবল লজ্জার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লজ্জার এমন কী বিশেষত্ব, যে কারণে অন্যসব শাখা থেকে বাছাই করে কেবল এর কথাই উল্লেখ করা হল? এর উত্তর মেলে অন্য এক হাদীসে। তাতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إنَّ ممَّا أدرك النَّاسُ من كلامِ النُّبوَّةِ الأولَى : إذا لم تستحْيِ فاصنَعْ ما شئتَ
‘মানুষ পূর্ববর্তী নবুওয়াতের যে বাণী লাভ করেছে (অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীদের যে শিক্ষা এ পর্যন্ত পৌঁছেছে) তা হচ্ছে- তুমি যদি লজ্জাই না কর তবে যা চাও করতে পার।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ৩৪৮৩)
অর্থাৎ যে ব্যক্তির লজ্জা নেই সে পারে না এমন কোন অপরাধমূলক কাজ নেই। যেকোন অন্যায়-অপরাধ লজ্জাহীন মানুষ অবলীলায় করতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তির লজ্জা আছে, সে সহজে অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। লজ্জা তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই কোন মন্দ কাজ করার ইচ্ছা জাগে, তখন লোকে দেখলে কী বলবে এই অনুভূতি তাকে সে কাজ করতে দেয় না। সে মনের ইচ্ছা মনেই দমন করে ফেলে। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কী অর্থপূর্ণ সরল বাণী-
الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِي إِلاَّ بِخَيْرٍ
‘লজ্জাশীলতা কেবলই কল্যাণ নিয়ে আসে।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ৬১১৭)
লজ্জাশীলতা শুধু ঈমানের শাখাই নয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লজ্জাশীলতাকে দ্বীন ইসলামের মূল চরিত্র হিসেবেই অভিহিত করেছেন-
إِنَّ لِكُلِّ دِينٍ خُلُقًا، وَخُلُقُ الإِسْلاَمِ الْحَيَاءُ.
‘প্রতিটি দ্বীনেরই একটি চরিত্র রয়েছে। ইসলামের চরিত্র হলো লজ্জাশীলতা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীসক্রম : ৪১৮১)