ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের পরিচয়  [সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ০৮]

 

حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، قَالَ أَخْبَرَنَا حَنْظَلَةُ بْنُ أَبِي سُفْيَانَ، عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ خَالِدٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ‏”‏‏.‏

হাদীসের তরজমা

হযরত ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘পাঁচটি জিনিসের উপর ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে।’ ১. ‘এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।’ ২. ‘নামায কায়েম করা।’ ৩. ‘যাকাত প্রদান করা।’ ৪. ‘হজ আদায় করা।’ ৫. ‘রমাযানের রোযা রাখা।’ (সহীহ বুখারী, হাদীসক্রম : ০৮)

হাদীসের ব্যাখ্যা

এ হাদীসটি একটি উপমামূলক হাদীস। ইসলামকে একটি তাঁবুর সাথে উপমা দেয়া হয়েছে এ হাদীসে। একটি তাঁবুতে সাধারণত পাঁচটি খুঁটি থাকে। চার কোণে চারটি এবং তাঁবুর মাঝে একটি, মোট পাঁচটি খুঁটি থাকে। মাঝের খুঁটিটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। চার কোণের যেকোনো একটি খুঁটি না থাকলেও তাবু সম্পূর্ণরূপে উপড়ে যায় না; বরং অপূর্ণাঙ্গ থাকে। অনুরূপভাবে দুটি বা তিনটি খুঁটি না থাকলেও একেবারে উপড়ে পড়ে না। কিন্তু মাঝের খুঁটিটি না থাকলে তাঁবুর অস্তিত্বই থাকে না। মাঝের খুঁটি ছাড়া চার কোণের চারটি খুঁটি বিদ্যমান থাকলেও তাকে সে অবস্থায় তাঁবু বলা যায় না।

অনুরূপভাবে ইসলামও পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। তন্মধ্যে মাঝের স্তম্ভ হলো, কালেমা অর্থাৎ তাওহীদ ও রিসালাতের পূর্ণ স্বীকৃতি। অপর চারটি স্তম্ভ হচ্ছে- নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ করা, রমাযান মাসের রোযা রাখা। যদি এ স্তম্ভচতুষ্টয়ের কোন একটি না পাওয়া যায়, তবে এক্ষেত্রেও ইসলাম অবশিষ্ট থাকে। যে ব্যক্তির মাঝে এ স্তম্ভটি বিদ্যমান থাকে তাকে মুসলিম হিসেবে আখ্যা দেয়া যাবে। পক্ষান্তরে তার মাঝে যদি এই স্তম্ভটি না থাকে অর্থাৎ, সে তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী না হয়, তবে তাকে মুসলমান বা মুমিন বলা যাবে না। অন্য চারটি স্তম্ভ বিদ্যমান থাকলেও এগুলো কোন কাজে আসবে না। যেমন : তাবুর মাঝের খুঁটি না থাকলে তাকে তাঁবু বলা যায় না এবং তা কোন কাজে আসে না।

একটি ঘটনা দ্বারা বিষয়টি আরো সুন্দরভাবে ফুটে উঠবে। প্রখ্যাত কবি ফারাযদাক ও হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি একটি জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে বললেন, ‘সকলকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে, তুমি আখেরাতের সফরের জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ?’ উত্তরে ফারাযদাক বললেন-شهاده ان لا اله الا الله وان محمدا عبده ورسوله  তাঁর কথা শুনে হাসান বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন- هذا العمود فاين الاتاد والاطناب  অর্থাৎ, এটি তো হলো স্তম্ভ। পেরেক ও রশি কোথায় যা দ্বারা তাঁবু স্থাপিত হয়?

بناء শব্দকে নির্বাচন করার কারণ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের মৌলিক বর্ণনায় بناء শব্দটিকে মনোনীত করেছেন এর কারণ হলো-

১. بناء শব্দের অর্থ হলো ‘ভিত্তি’। আর ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়; যথা- ঈমান, নামায, রোযা, হজ ও যাকাত; এগুলো হলো ইসলামের মূল ভিত্তি। একথা বুঝানোর জন্য তিনিبناء  শব্দটিকে নির্বাচন করেছেন।

২. কোনো জিনিস যেরূপ ভিত্তি ও মূলনীতি ছাড়া প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না, তদ্রুপ ইসলামও উল্লিখিত পাঁচটি মৌলিক বিষয় ছাড়া প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। এ কথা বুঝানোর জন্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রসঙ্গে بناء শব্দটি নির্বাচন করেছেন।

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উক্তি দিয়ে ইসলামকে একটি ঘরের সাথে তুলনা করেছেন। এই হিসেবে যে, ঘর যেমন মানুষকে শীতাতপ, বর্ষা-বাদল ও নানাবিধ প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে, তেমনি ইসলাম মানুষকে আল্লাহ তাআলার লৌকিক পারলৌকিক রোষ ও সামাজিক অনাচার থেকে রক্ষা করে। তার ঘর প্রতিষ্ঠা করার জন্যে চাই بناء তথা মূলভিত্তি। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য بناء  শব্দটি নির্বাচন করেছেন।

৪. খুঁটির উপর যেরূপ ঘর নির্ভর করে থাকে, অনুরূপ উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের উপরও ইসলাম নির্ভর করে থাকে। এ কথা বুঝানোর জন্যেইبناء  শব্দটিকে নির্বাচন করা হয়েছে।

এ পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার কারণ

ইসলামের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা থাকা সত্বেও এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলেন কেন? এর জবাবে হাদীস বিশারদগণ বলেন-

১. ইসলামের অসংখ্য শাখা-প্রশাখার মধ্যে উল্লিখিত পাঁচটি বিষয় হচ্ছে প্রধান ও উল্লেখযোগ্য মৌলিক বিধান। আর অন্যগুলো এ পাঁচটির পরিপূরক। তাই বিশেষভাবে এ পাঁচটিকে উল্লেখ করা হয়েছে।

২. প্রসিদ্ধতার দৃষ্টিকোণ থেকে এ পাঁচটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. ফরয হওয়ার দিক বিবেচনায় বিশেষভাবে উল্লিখিত পাঁচটির কথা বলা হয়েছে।

ইসলামের রুকন চতুষ্টয়ের ফরয হওয়ার ক্রমধারা

নামায ফরয হওয়ার সময়কাল : পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মতের উপর নামায বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে ফরয হলেও আমাদের উপর মেরাজের রাতেই নামায ফরয করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের আলেম ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে তাঁরা মেরাজের রাতের তারিখ নির্ধারণে মতবিরোধ করেছেন। প্রসিদ্ধ মত হলো হযরত খাদীজা রাযিআল্লাহু আনহা এর ওফাতের পর এবং বাইয়াতে আকাবার পূর্বে মেরাজ সংঘটিত হয়েছে। অধিকাংশ আলেম এ মতই পোষণ করেছেন। উপরন্তু, এ বক্তব্য হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত যে, হযরত খাদীজা রাযিআল্লাহু আনহা পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। আর এটাও স্বীকৃত যে, হযরত খাদীজা রাযিআল্লাহু আনহা শিবে আবী তালিবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গী ছিলেন। শিবে আবী তালেব থেকে বেরিয়ে আসার পর তিনি ইন্তেকাল করেন। উল্লিখিত বিবরণ থেকে এ ফলাফল বেরিয়ে আসে যে, মেরাজ নবুওয়তের দশম বছরের পর একাদশ নবমী বর্ষে তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কোন এক মাসে সংঘটিত হয়েছে। আর এ মাস ও তারিখের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ মত হলো, রজব মাসের ২৬ তারিখের দিবাগত ২৭ এর রাত।

রোযা ফরয হওয়ার সময়কাল : সকল আলেমের ঐকমত্যে রমাযানের রোযা ফরয হয়েছে দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে।

যাকাত ফরয হওয়ার সময়কাল : জমহুর উলামায়ে কেরামের মতে যাকাত হিজরতের পর মদীনায় ফরয হয়েছে। তবে যাকাত ফরয হওয়ার ব্যাপারে হিজরতের পূর্বাপর নিয়ে যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে এর সমাধানে ইবনে কাছীর রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সূরা মুযযাম্মিলে واقيموا الصلاه واتوا الزكاه এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘যাকাত মক্কায় ফরয হয়েছে কিন্তু এর পরিমাণ অবতীর্ণ হয়েছে মদীনায়।’

হজ ফরয হওয়ার সময়কাল : হজ ফরয হওয়ার সময়কাল নিয়ও ওলামায়ে কেরামের মাঝে বিরোধ রয়েছে। তবে ইমাম নববী, ইমামুল হারামাইন, কাজী আয়ায, কুরতুবী প্রমুখের সিদ্ধান্ত ও গ্রহণীয় অভিমত হলো, হজ নবম হিজরীতে ফরয করা হয়েছে। আর এর দলীল হলো এই আয়াত-ولله على الناس حج البيت من استطاع اليه سبيلا  আয়াতটি নবম হিজরীর শেষ দিকে নাযিল হয়েছে।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT