ইসলামের দৃষ্টিতে যবানের হেফাজত : গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা [সহীহ বুখারী, হাদীস-ক্রম : ১০]

 

حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ الْقُرَشِيِّ، قَالَ حَدَّثَنَا أَبِي قَالَ، حَدَّثَنَا أَبُو بُرْدَةَ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِي بُرْدَةَ، عَنْ أَبِي مُوسَى ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ الإِسْلاَمِ أَفْضَلُ قَالَ‏ “‏ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‏”‏‏.‏

হাদীসের তরজমা :

সাঈদ ইবনে ইয়াহইয়া… হযরত আবু মুসা রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! ইসলামে কোন আমলটি সবচেয়ে উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।’ (বুখারী, হাদীস-ক্রম : ১০)

হাদীসের ব্যাখ্যা :

আল্লামা ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, المسلمون শব্দ দ্বারা শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রে কল্যাণকামী হতে হবে অমুসলিমদের সাথে ভালো ব্যবহার করা যাবে না এ অর্থ বুঝানো হয়নি। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো একজন মুসলিমকে অবশ্যই সকল মানুষের জন্যই কল্যাণকামী হতে হবে।

সুতরাং যদি কারো সাথে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক না থাকে তাহলে মানবতার খাতিরে তার সাথেও ভালো ব্যবহার করতে হবে। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে- (المؤمن من امنه الناس على دمائهم واموالهم) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, সকল মানুষের সাথেই ভালো ব্যবহার করতে হবে। হাদীসে উল্লিখিত الناس শব্দটি ব্যাপকতার দিকে ইঙ্গিত করেছে।

অমুসলিম যদি যিম্মি বা নিরাপত্তা গ্রহণকারী হয় তাহলে সেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিধানে মুসলমানদের মতোই। কেননা তাদের ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (اموالهم كاموالنا ودماءهم كد مائنا) অর্থাৎ ‘তাদের মাল ও রক্ত আমাদের মাল ও রক্তের মতোই।’ সুতরাং মুসলমানদের মতো তাদের প্রতিও পূর্ণরূপে সদাচরণ করতে হবে। উল্লেখ্য, যে সকল কাফেরদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি হয়েছে তারাও যিম্মিদের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত।

জিহ্বা ও হাতকে বিশেষভাবে উল্লেখের কারণ :

আলোচ্য হাদীসে প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় দিতে গিয়ে তার মুখ ও হাত সংযত করার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ বর্ণনায় হাদীস বিশারদগণ কতিপয় ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। যেমন-

১. ব্যক্তিগত জীবনে মানুষ অধিকাংশ কাজই এ দুটি অঙ্গ দ্বারা সম্পাদন করে থাকে। তাই এ দুটি অঙ্গ সংযত রাখার কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২. অধিকাংশ সময় অপরের কল্যাণ বা অকল্যাণ করার ক্ষেত্রে এ দুটি অঙ্গই মানুষের প্রধান হাতিয়ার হয়ে থাকে। তাই বিশেষভাবে এ দুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. মানুষের বাহ্যিক আচরণ মুখ দ্বারা প্রকাশিত হয় আর দৈহিক শক্তি হাত দ্বারা প্রকাশিত হয়। তাই এ দুটিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাতের পূর্বে জিহ্বাকে উল্লেখ করার কারণ :

মুহাদ্দিসগণ এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-

১. সাধারণত সর্বপ্রথম মৌখিক কথাবার্তা তারপর হাতের বিষয়টির প্রয়োগ হয়। এজন্য জিহ্বা প্রসঙ্গকে আগে বলা হয়েছে।

২. জিহ্বা ব্যবহার করা সহজ, তাই এর ব্যবহার অধিক হয়। এজন্য জিহ্বার আলোচনা পূর্বে আনা হয়েছে।

৩. জিহ্বা দ্বারা কষ্টের কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা অধিক। এমনকি বিশেষ ব্যক্তিবর্গও এতে লিপ্ত হয়ে থাকে।

৪. জিহ্বা দ্বারা উপস্থিত অনুপস্থিত এমনকি জীবিত-মৃত সকলকে কষ্ট দেয়া যায়, কিন্তু হাত দ্বারা এরূপ করা যায় না।

৫. জিহ্বা দ্বারা প্রদত্ত কষ্ট অনেক ক্ষেত্রে হাতের আঘাতের চেয়েও অধিক প্রতিক্রিয়াশীল হয়। কবি কতই না চমৎকার বলেছেন-

جراحات السنان لها التئام ** ولا يلتام ما جرح اللسان

‘ছুরিকাঘাতের ক্ষতের আরোগ্যের জন্য প্রতিষেধক পাওয়া যায়। কিন্তু জিহ্বা দ্বারা প্রাপ্ত আঘাতের ক্ষত কখনোই সেরে উঠে না।’

গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :

আল্লাহ তাআলার নিয়ামতরাজির মধ্যে যবান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সঠিক কাজে যবান ব্যবহার করা, অন্যায়-অসত্য ও হারাম থেকে বিরত রাখা আল্লাহ তাআলার দীদার লাভের সহজ উপায়। এককথায় যবানের হেফাজত করা মুমিন জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পবিত্র কুরআনের সূরা মুমিনুনের শুরুতে আল্লাহ তাআলা খাঁটি মুমিনগণের সাতটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে দ্বিতীয় গুন হচ্ছে ‘যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত।’ উক্ত আয়াতেلغو  শব্দের অর্থ- অনর্থক কথা বা কাজ।

সূরা আহযাবে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

 يا ايها الذين امنوا اتقوا الله وقولوا قولا سديدا يصلح لكم اعمالكم ويغفر لكم ذنوبكم.

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যক্রমসমূহ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন।” (সূরা আহযাব, আয়াতক্রম : ৭০-৭১)

আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে তাকওয়া অবলম্বন তথা সব ধরনের নাফরমানী ছেড়ে দিতে বলেছেন। এর সাথে সাথেই যবানের সদ্ব্যবহার তথা সত্য-সঠিক কথা বলতে বলেছেন। কেননা যবান হলো নাফরমানির বড় হাতিয়ার। তাই তাকওয়ার সাথেই যবানে সত্য-সঠিক কথা বলতে বলেছেন। যবান সঠিক হয়ে গেলে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গও সংশোধন হয়ে যাবে। তাই এর পরেই সব আমল সংশোধন ও গুনাহ মাফের ঘোষণা দিয়েছেন। আর অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত, যারা যবানের হেফাজত করতে পারে তারা অন্যান্য গুনাহ থেকে সহজেই বাঁচতে পারে। যবানের ব্যাপারে শিথিলতা অনেক বড় বড় বিপদ ডেকে আনে। দেখা যায় দু’একটি কথার সূত্র ধরে বউ শাশুড়ি কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বড় ধরনের ঝগড়া-বিবাদ হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা যবান হেফাজতের তাগিদে অন্য আয়াতে এভাবে ইরশাদ করেছেন-

ما يلفظ من قول الا لديه رقيب عتيد

“মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত আছে যে (লেখার জন্য) সদা প্রস্তুত।” (সূরা কাফ, আয়াতক্রম : ৫০)

যবানে উচ্চারিত সবকিছুই ফেরেশতারা সংরক্ষণ করে রাখেন। ভালো-মন্দ ছোট-বড় সবকিছুই তারা লিপিবদ্ধ করেন। কেয়ামতের দিন এগুলোর হিসাব দিতে হবে। সেই দিন জিহ্বা, হাত-পা-সহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও সাক্ষী দিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

يوم تشهد عليهم السنتهم وايديهم وارجلهم بما كانوا يعملون

“যেদিন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত-পা সাক্ষ্য দিবে।” (সূরা নূর, আয়াতক্রম : ২৪)

যবান হেফাজতের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন-

من كان يؤمن بالله واليوم الاخر فليقل خيرا او ليصمت

‘যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারী, হাদীসক্রম : ৬০১৮)

একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকবা ইবনে আমির রাযিয়াল্লাহু আনহুকে তিনটি ওসিয়ত করলেন। এর প্রথমটি ছিল- (املك عليك لسانك) ‘তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো।’

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন-

والذي لا اله غيره ما على الارض شيء احوج الى طول سجن من لسان

‘সেই সত্তার কসম যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; ভূপৃষ্ঠে সবকিছুর চেয়ে জিহ্বাই সবচেয়ে বেশি বন্দিত্ব ও নিয়ন্ত্রণের মুখাপেক্ষী।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীসক্রম : ১৮১৮৪)

কোন দার্শনিক বলেছিলেন-

ما ان ندمت على سكوتي مرة ولقد ندمت على الكلام مرارا

‘আমি কখনো আমার নীরবতার উপর অনুতপ্ত হয়নি। তবে বহুবার কথার কারণে লজ্জিত হয়েছি।’

যবানের বড় বড় গুনাহ :

যবানের দ্বারা মানুষ অনেক বড় বড় গুনাহে লিপ্ত হয়। যবান আমলের খাতাকে কলুষিত করে। কিয়ামতের দিন এই যবানই মানুষের মহাবিপদের কারণ হবে। যবানের দ্বারা সংঘটিত কিছু পাপ নিয়ে আলোচনা করা যাক।

গীবত : যবানের দ্বারা সংগঠিত গুনাহের মধ্যে গীবতেই মানুষ সবচেয়ে বেশি লিপ্ত হয়। কম মানুষই এ থেকে বাঁচতে পারে। এ ব্যাপারে অবহেলার অন্ত নেই। জেনে না জেনে বুঝে না বুঝে গীবত করতে থাকে। সকালে গীবত করে, বিকালে গীবত করে, রাতে গীবত করে; গীবতই যেন কারো কারো সারাদিনের একমাত্র কাজ। ক’জন একত্রিত হলে প্রথম কাজ যেন গীবত। এটা মানুষের সমাজে শত ফাসাদের কারণ। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এর নিকৃষ্টতা বর্ণনা করেছেন নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনার মাধ্যমে।

পরনিন্দা : সামাজিক ফাসাদের ক্ষেত্রে পরনিন্দা আরো মারাত্মক। পরনিন্দা বলা হয়- বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একের দোষ অন্যের কাছে লাগানো। পরনিন্দাকারী অন্যকে লাঞ্ছিত করতে গিয়ে একসময় নিজেও লাঞ্ছিত হয়; যখন মানুষ তার আসল উদ্দেশ্য জেনে যায়। পরনিন্দাকারীর পরিণাম বড় ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- (لا يدخل الجنة نمام) ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’

মিথ্যা : মিথ্যা সকল পাপের মূল। মুনাফিকের স্বভাব। মুমিন মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যার পরিণাম জাহান্নাম।

মিথ্যা সাক্ষ্য : মুমিন কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারে না।

মিথ্যা কসম : কসম করা হয় কাউকে কোন কথা বিশ্বাস করানোর জন্য। নিজের কথা বা কাজের সুসত্যতা প্রমাণের জন্য। এখন যার মাধ্যমে সত্য সুপ্রমাণিত করা হয়, সেটির ভিত্তি যদি মিথ্যার উপর হয়, তখন এটি কতই না মারাত্মক অন্যায় বলে গণ্য হয়। তাছাড়া কসম হয় আল্লাহর নামে। মিথ্যা, আবার আল্লাহর নাম নিয়ে মিথ্যা। চুরি আবার সিনাজুরি। এটি চূড়ান্ত পর্যায়ের অন্যায়।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যবানের যাবতীয় অনিষ্ট হতে রক্ষা করুন। এই নেয়ামতকে ভালো কাজে ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT