ছাত্রজীবন ও এ কয় বছরের শিক্ষকতাজীবনে আমি যতটুকু দেখেছিÑ ছাত্রদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ইবারত বুঝতে না পারা। সমস্যাটির দুটি দিকÑ শুদ্ধভাবে পড়তে না পারা এবং অর্থ বুঝতে না পারা। এই বিষয়-দুটো পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আমরা যাকে বলি একই মদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সমস্যাটি সবার যে থাকে তা নয়; তবে আমার পর্যবেক্ষণমতে তাঁদের সংখ্যাটি সমস্যামুক্তদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি।
এখানে বেশ একটা দুঃখজনক ব্যাপারও ঘটে। অনেক তালিবুল ইলমকে দেখা যায় নিচের জামাতগুলোতে তাঁরা খুব ভালো করেন ঠিক, কিন্তু নবম শ্রেণি অর্থাৎ কাফিয়া জামাতে যাওয়ার পর থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে শুরু করেন। পরবর্তী সময়গুলোতে তাঁদেরকে আর দশের ভেতরেও খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনও হয় এক মাদরাসায় হয়তো তিনি ভালো ছাত্র হিসেবে বরিত, কিন্তু এর চেয়ে আরেকটু ভালো মাদরাসায় যাওয়ার পর আর প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। এর পেছনে বেশ কিছু সমস্যা সরাসরি ভ‚মিকা রাখে। সবগুলোকে এক শব্দে বললে বলা যায় যে, তাঁদের মৌলিক যোগ্যতাটি আসলে গড়ে ওঠেনি। সে সমস্ত কারণের মধ্যে সর্বাগ্রে থাকে এই ইবারতের সমস্যাটি। নিচের জামাতগুলোতে যেহেতু পড়ার পরিমাণ তুলনামূলক কম, কিতাবগুলোর আরবীও সহজ, আরবী সাবজেক্টের বাইরে সাধারণ আরো বেশ কিছু সাবজেক্ট থাকে, যেগুলো থেকে মোটামুটি নাম্বার তুলে ফেলা যায়, তাই সব মিলিয়ে মুখস্থ আর সুন্দর হাতের লেখা দিয়ে পরীক্ষাগুলো ভালোভাবে পার করে আসা সম্ভব হয়। কিন্তু কাফিয়া ও এর পরের শ্রেণিগুলোতে সে সুযোগটা ধীরে কমতে শুরু করে। এবং যত সামনে এগুবে, পথচলা তত কঠিন হয়ে উঠবে। কারণ, ততদিনে শাস্ত্রীয় আলোচনা শুরু হয়ে যায়, কিতাবপত্রের বক্তব্যও জটিল হতে শুরু করে। এখানে মুখস্থ দিয়ে পার পাওয়া মুশকিল।
আমাদেরকে একটা জিনিস খুব সচেতনভাবে বুঝতে হবে—আমরা যে ইলম অর্জন করে আলেম হতে চাচ্ছি, সেই ইলমটি বন্দি হয়ে আছে শব্দ ও হরফের মোড়কের ভিতর। শব্দের এ মোড়ক খুলে কথাটা নিজের ভাষায় পেয়ে গেলেই যে বুঝে ফেলব, তা কিন্তু নয়। কারণ, শাস্ত্রীয় আলোচনা যত উপরে যায়, তত গভীর হয়। আর যত গভীর হয়, বুঝাটা তত জটিল হয়। সে হিসেবে আমাদের ইলমি সফরের চিত্রটি মোটামুটি এরকম:
১. ইবারত সমাধান করা।
২. নিজের ভাষায় বক্তব্য উদ্ধার করা।
৩. উদ্ধারকৃত বক্তব্য খুঁটে খুঁটে বিশ্লেষণের সাথে বুঝা।
৪. অতঃপর পুরো বিষয়টি আত্মস্থ করা।
৫. অর্জিত এ তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রয়োজনীয় জায়গায় প্রয়োগ করে ইলমকে অর্থবহ করে তোলা।
মোটামুটি দীর্ঘ একটা সফর। কিন্তু বর্তমানে দুঃখজনক বিষয় হলো বেশিরভাগ ছাত্রেরই ইবারত সমাধান করে নিজের ভাষায় লেখকের বক্তব্যটি হস্তগত করতেই সকল সময় ও পরিশ্রম খরচ হয়ে যায়। ফলে, উদ্ধারকৃত বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আত্মস্ত করার জন্য সময় দেওয়া হয়ে উঠে না।
ইবারতের বিষয়টি নিয়ে একটু পর বলছি। তার আগে আত্মস্থ করার বিষয়টা একটু পরিস্কার করা যাক। এখানে একই গোত্রভুক্ত বেশ কয়েকটি শব্দ আছে:আত্মস্থ, কণ্ঠস্থ, মুখস্থ, ঠোঁটস্থ। এর ভিতর থেকে আমরা আত্মস্থ শব্দটা গ্রহণ করেছি। এ শব্দটির সাথে বাকি শব্দ তিনটির ব্যবধান অনেক। কারণ, আত্মস্থ করা মানে কোন কিছুকে আত্মার ভিতরে নিয়ে আসা। শুধু মুখস্থ করে এটা সম্ভব নয়। তার আগে আপনাকে বক্তব্যটা বুঝতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে, বিস্তারিতভাবে দৃশ্যায়ন করতে হবে, নিমগ্ন ফিকিরের মাধ্যমে হৃদয় দিয়ে একে অনুভব করতে হবে গভীরভাবে,এরপর মুখস্থ করতে হবে। সবকিছু করার পর বিষয়টি নিয়ে আপনার ভিতরে যে স্বচ্ছ বুঝ ও উপলব্ধি তৈরী হবে, সেটিই হচ্ছে আত্মস্থকরণ। এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। এভাবে নিয়ে আসতে পারলেই বলা যাবে আপনি বিষয়টিকে সর্বোতভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন। এ ইলম থেকে যাবে, কাজে লাগবে, এবং এ দিয়ে নতুন ইলম উৎপাদন করা যাবে।
বেশিরভাগ সময় আমরা শুধু বক্তব্যটা ইবারতের ভিতর থেকে বের করে এনে নিজের ভাষায় হস্তগত করি। বিশ্লেষণের সুযোগ পাই কম। তাড়াহুড়ো বা মনোযোগের ঘাটতির কারণে সামান্য করলেও তা হয় ভাসা ভাসা। ফলে আত্মস্থ করা বলতে গেলে হয়েই উঠে না। কাজে লাগানো তো পরের ব্যাপার। ফলাফল দাঁড়ালো কী? আমি জমি আবাদ করলাম, হাল চাষ দিলাম, বীজ ফেললাম, নিড়ানি দিলাম। এতো পরিশ্রমের পর যখন ফসল ফললো, তখন সেসব অবহেলায় ফেলে দিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।
এর পরিণতিটাও আমাদেরকে ভোগ করতে হয় নিদারুণভাবে। খেয়াল করলে দেখবেন, হেদায়াতুন্নাহুতে আপনি ফায়েলের যে সংজ্ঞাটা মুখস্থ করেছিলেন, কাফিয়াতে গিয়ে বলতে গেলে সে একই সংজ্ঞা নতুন করে মুখস্থ করতে হচ্ছে, আবারো পরিশ্রম করতে হচ্ছে অর্থ উদ্ধারের পেছনে। এবং খুবই দুঃখজনক যে, বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলার পর এটিও আপনি ভুলে যাবেন। দু বছর লাগিয়ে আপনাকে কুদুরি পড়ানো হয়েছে হেদায়ায় গিয়ে যেন মাসআলাগুলোর বিশ্লেষণটা আপনি সুন্দরভাবে ধরতে পারেন। আপনি যদি কুদুরিটা সেভাবে আত্মস্থ করে সাথে নিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে আপনার ভিতরে হেদায়ার জটিল বিশ্লেষণগুলোর উপযুক্ততা ও পিপাসা এমনিতেই তৈরী হয়ে যেত। তখন হেদায়া কিতাবের প্রতিটা বিশ্লেষণ হতো তপ্ত মরুর বুকে শীতল বৃষ্টির ফোঁটার মত। বিশ্লেষণগুলো সামনে আসার সাথে সাথে আপনার আত্মা একে শুষে নিত তৃষিত মানুষের মতো। কিন্তু আমাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে না। আমরা হেদায়ায় গিয়েও কুদুরির মাসআলাগুলোই আবার নতুন করে শিখতে গলদঘর্ম হই।
পঠিত ইলম আত্মস্থ না করার আরেকটা পরিণতি হলো আমাদের ভিতরে ইলম সঞ্চিত হয় না। প্রতি বছর আমরা নতুন একটি শ্রেণীতে ভর্তি হই সম্পূর্ণ ফ্রেশ হয়ে। মানে, পেছনের জামাতের পড়াগুলো আমাদের সাথে থাকে না। একদম যে থাকে না, তা কিন্ত বলছি না। কিন্তু যতটুকু থাকা দরকার ছিল, থাকে তারচেয়ে অনেক কম। যার ফলে, দাওরায়ে হাদীস শেষ করে বের হবার সময় সান্ত¡না পাবার মতো খুব কিছু নিজের ভেতরে খুঁজে পাই না।
এই যে দুঃখজনক পরিস্থিতি, এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলো ইবারতের দুর্বলতা। এটা শুধু যে আপনাকে কিতাবের পড়া বুঝতেই অসুবিধা করে তা নয়, আপনার পড়ালেখার উৎসাহও নষ্ট করে। এ জন্য যাঁরা নিচের দিকে আছেন, মীযান, নাহবেমীর বা হেদায়াতুন্নাহু জামাতে, তাঁরা এখন থেকেই সচেতন হোন। ইবারতে উন্নতি হচ্ছে কি না সতর্কতার সাথে নিজের প্রতি খেয়াল রাখুন। পেরেশান হোন। এখন হেদায়াতুন্নাহু, নূরুল ঈযাহ-এর ইবারত খুব সহজে এবং বিশুদ্ধভাবে নিজে নিজেই পড়তে পারার কথা। অন্তত বছরের মাঝামাঝি যাওয়ার পর তো কোনো ভুল হওয়া উচিতই নয়। শুধু এটুকু যে, কোনো শব্দের অর্থ জানা না থাকলে সেটি কেবল অভিধান থেকে দেখে নিতে হবে। আর যাঁরা কাফিয়া পার করে চলে এসেছেন, কিন্তু ইবারতে সমস্যা থেকে গেছে, এমনকি যদি দাওরা বা মিশকাতেও উঠে থাকেন, তবু খুব নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি, এ সমস্যা কাটানোর জন্য এক মাসের বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সে আলোচনায় যাওয়ার আগে বিশেষ একটা ভুল ভাঙানো দরকার মনে করছি।
আমার দেখা মতে ইবারতে দুর্বলতা আছে এমন প্রায় সকলেরই ধারণা, ইবারত ভালোভাবে পড়তে হলে নাহু-সরফ তালীল-তারকীব ইত্যাদি এ-টু-জেড মুখস্থ করে ফেলতে হবে। অর্থাৎ, নাহু-সরফে বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়া ইবারতের দুর্বলতা কাটানো সম্ভব নয়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আপনাদেরকে একটা বিষয় বুঝতে হবে : নাহু সরফ নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অসংখ্য শাখাপ্রশাখা বিশিষ্ট বিস্তারিত একটা শাস্ত্র। এর নিজস্ব ইতিহাস আছে, অসংখ্য রিজাল ও ইমামগণ আছেন, নতুন-পুরনো অসংখ্য বইপত্র আছে, আছে এর দর্শন ও তত্ত¡। শাখাপ্রশাখার তো অভাবই নেই। আপনি যদি নাহুবিদ হতে চান, তাহলে এখানের সবকিছু আপনাকে জানতে হবে। কিন্তু ইবারত শুদ্ধভাবে পড়ার জন্য প্রাথমিকভাবে এত কিছু লাগে না। মুহাক্কিক আলিম হওয়ার জন্য নাহু-সরফের গভীর জ্ঞানের আবশ্যকীয়তা অস্বীকার করছি না; কিন্তু কিতাবের ইবারত পড়তেই যাঁদের অসুবিধা হচ্ছে, তাঁদের জন্য যে নাহুবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই এ নিশ্চিত করেই বলা যায়। যতটুকু লাগে, এর বেশিরভাগ আপনি পারেন, হয়তো নিজেও জানেন না। অনেক বিষয় তো পরিস্কারভাবেই পারেন। আর কিছু বিষয় আছে মনোযোগ ও চর্চার অভাবে ঝাপসা হয়ে আছে। কাজে লাগাতে শুরু করলে খুব দ্রæত সেগুলোও আয়ত্বে চলে আসবে। তাই ইবারতের সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে আলাদা সময় নিয়ে নাহু-সরফ আচ্ছামতো পড়ে ফেলবার যে বিশেষ স্বপ্ন অনেকে লালন করেন এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণে যে হতাশার চর্চা করেন, তা নিতান্ত ক্ষতিকর। এই স্বপ্ন আপনাকে একটা আক্ষেপের ভেতর বন্দী করে আপনার বর্তমানটিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই একদম শুরুতেই অনুরোধ করব এমন মনোভাব থাকলে তা থেকে বেরিয়ে আসুন।
ইবারত শুদ্ধ করার জন্য কতটুকু লাগে তাহলে? প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী? তা কীভাবে আয়ত্ত করা যায়? এসব বিষয় নিয়ে সামনের সংখ্যায় কথা হবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : শিক্ষক, দারুল ইরশাদ ওয়াদ দা’ওয়াহ আল ইসলামিয়া, বহুলা, হবিগঞ্জ