عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: مَنْ تَرَدَّى مِنْ جَبَلٍ فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَهُوَ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ يَتَرَدَّى فِيْهِ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا وَمَنْ تَحَسَّى سُمًّا فَقَتَلَ نَفْسَهُ فَسُمُّهُ فِيْ يَدِهِ يَتَحَسَّاهُ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِحَدِيْدَةٍ فَحَدِيْدَتُهُ فِيْ يَدِهِ يَجَأُ بِهَا فِيْ بَطْنِهِ فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدًا مُخَلَّدًا فِيْهَا أَبَدًا.
অনুবাদ
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম ﷺ বলেছেন-যে ব্যক্তি পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে, চিরকাল সে জাহান্নামের ভেতর ওইভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে ব্যক্তি লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনের ভেতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে। [বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ৫৭৭৮; মুসলিম শরীফ, হাদীস-ক্রম : ১০৯]
ব্যাখ্যা
আল্লাহ তাআলা মানুষের আত্মা সৃষ্টি করে মানুষের নিকট তা আমানত হিসেবে রেখেছেন। মানুষ নিজে স্বীয় আত্মার মালিক নয়। মালিক কেবল আল্লাহ তাআলা। তাই মানুষ নিজে নিজের আত্মা বিনষ্ট করার অধিকার রাখে না। নিজে নিজেকে ধ্বংস করাকে আত্মহত্যা বলে। ইদানীং আত্মহত্যার প্রবণতা একটু বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষ তুচ্ছ কোনো বিষয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অথচ ইসলামী দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা একটি জঘন্যতম মহাপাপ। আল্লাহ মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টি করেন এবং একমাত্র তিনিই মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে নিজেই নিজেকে হত্যা করে ফেলে। এ কারণে এটি একটি গর্হিত কাজ। কবীরা গুনাহ।
মহান আল্লাহ এমন কাজ মোটেই পছন্দ করেন না। এ কারণে রাসুল ﷺ নিজে কখনও আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়াননি। এ থেকেই বোঝা যায় যে, আত্মহত্যা কত বড় পাপ। এটা বান্দার ইহকাল, পরকাল উভয় জগৎ ধ্বংস করে। উপরন্তু আত্মহত্যা প্রসঙ্গে রাসূল ﷺ কঠোর হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারণ করে গেছেন। যেমনটি আমরা উপরোক্ত হাদীস থেকে বুঝতে পারি।
আত্মহত্যার কারণ
ইতিহাস ও সমকাল পর্যালোচনা করলে আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ বেরিয়ে আসে। সাংসারিক কলহ-দ্বন্দ্বে পড়ে, অতিরিক্ত রাগের কারণে, কাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু লাভ করতে না পারলে, নিরাশ বা বঞ্চিত হওয়ার কারণে, লজ্জা ও মানহানিকর কোনো কিছু ঘটে যাওয়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রকাশ হওয়া, অভাব-দারিদে্র্যর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হওয়ার কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে।
এ ছাড়া আরও যে-সব কারণে আমাদের সমাজে জঘন্য এই কাজটি ঘটে, তা হলো-স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য, যৌতুকের কারণে ঝগড়া-বিবাদ, পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য, পরীক্ষায় ব্যর্থতা, অবৈধ প্রেম-বিরহ, মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদে পড়ে, ব্যবসায়ে বারে বারে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি। যখন জ্ঞান-বুদ্ধি-উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়, তখনই মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীও এই পথে পা বাড়ান। আত্মহত্যা যেমন যুবক ও প্রৌঢ়দের মধ্যে দেখা যায়, তেমনি তা নারী-পুরুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত ধৈর্যের অভাবেই মানুষের মাঝে এমন একটি মহাপাপের বিস্তার ঘটছে। আর শয়তানের কুমন্ত্রণা তো আছেই।
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে আত্মহত্যা থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন : সুরা নিসা’র ২৯ নম্বর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা আত্মহত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।’
অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াতক্রম : ১৯৫)
তাছাড়া আলোচ্য হাদীস-সহ একাধিক হাদীসে আত্মহত্যার ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এক হাদীসে রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিল। সে আহত হয়ে ছটফট করতে লাগল। এ অবস্থায় সে ছুরি নিয়ে নিজেই নিজের হাত কাটল ও ব্যাপক রক্তপাত ঘটল এবং তার মৃত্যু হলো। আল্লাহ এ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, “আমার এ বান্দা নিজের ব্যাপারে খুব তাড়াহুড়া করে ফেলছে। এ কারণে আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি।” (বুখারী শরীফ, হাদীসক্রম : ৩২৭৬)
আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
আত্মহত্যা একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যধি। বর্তমান সমাজের জন্য তা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দৈনিক পত্রিকায় অথবা সংবাদমাধ্যমে আত্মহত্যার খবর পেয়ে আমরা বেদনায় কেঁপে উঠি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে আজ আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একটি কথা মনে রাখা জরুরি যে, আত্মহত্যা শুধু একটি জীবনকে শেষ করে দেওয়া নয়; বরং একটি পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র এমনকি গোটা মানব জাতিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি।
কিন্তু কীভাবে? সে নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার কোনো অন্ত নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি আত্মহত্যার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, ডিপ্রেশন, দাম্পত্য কিংবা যে কোনো সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা এবং পারিপার্শ্বিক অসহযোগিতা। তাদের মতে, এগুলো থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারলে আত্মহত্যা এবং তার প্রবণতা কমিয়ে আনা কিংবা বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু ভাববার বিষয় হলো, কখনও কি ওইসব বিষয় থেকে সমাজকে পুরোপুরি মুক্ত করা আদৌ সম্ভব? অবশ্যই না।
পৃথিবীর শুরু থেকেই মানুষ দারিদ্র্যকে জয় করার চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে; কিন্তু সেই দারিদ্র্য কমার পরিবর্তে ভিবিন্ন রূপে বেড়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষটিও অনেক কিছুরই অভাব বোধ করে। পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহও ঠিক ওইরূপ। সম্পর্ক যতদিন থাকবে, দ্বন্দ্ব-কলহও ততদিন থাকবে। এটিই নিয়ম। সুতরাং উল্লেখিত ওই সমস্যাগুলো নিরসন করতে না পারলে আত্মহত্যা এবং এর প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না, এমন কথা যুক্তিহীন ও অনর্থক।
আমরা বলতে চাই, আত্মহত্যা নিরসনের উপায় অবশ্যই আছে। আর তা হলো, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং এতদসংক্রান্ত শিক্ষা। ব্যক্তিজীবনে যতদিন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বাস্তবায়ন না হবে ততদিন কোনো উপায়েই এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না। আর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জোগান দিতে পারে একমাত্র ধর্ম। সে ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ও আল্লাহর কাছে মনোনীত ধর্ম হিসেবে ইসলামই একমাত্র সমাধান।
আত্মহত্যাকারীর জানাযার নামাজের বিধান
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই শিরককে মাফ করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য যত গুনাহ হোক না কেন তিনি যাকে চান মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেছে সে এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গুনাহের কাজ করেছে।’ (সূরা নিসা, আয়াতক্রম : ৪৮)
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ‘আর আগামীতে তাদের মধ্য থেকে কেউ মারা গেলে তার জানাযার নামাযও তুমি কখনো পড়বে না। এবং কখনো তার কবরের পাশে দাঁড়াবে না। কারণ, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তাদের মৃত্যু হয়েছে ফাসিক অবস্থায়।’ (সূরা তাওবা, আয়াতক্রম : ৮৪)
তাবুকযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনু উবাই মারা যায়। তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনু আবদিল্লাহ ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান। তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাজির হয়ে কাফনে ব্যবহারের জন্য তাঁর কোর্তা চাইলেন। নবীজি অত্যন্ত উদার হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে কোর্তা দিয়ে দিলেন। আবদুল্লাহ এবার নবীজিকে জানাযা পড়াবার অনুরোধ করলেন। তিনি এ জন্যও তৈরি হয়ে গেলেন। হযরত উমর রাদি. বারবার এ মর্মে আবেদন জানাতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি এমন ব্যক্তির জানাযার নামায পড়াবেন, যে সারা জীবন ইসলামের বিরোধিতা করেছে?’ কিন্তু রহমতের আধার নবীয়ে পাক এ কথা শুনে মুচকি হাসলেন। তাঁর অন্তরে শত্রু-মিত্র সবার প্রতি যে করুণার ধারা বহমান তারই কারণে তিনি ইসলামের এ নিকৃষ্টতম শত্রুর মাগফিরাতের জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করতেও ইতস্তত করলেন না। শেষে যখন জানাযা পড়াবার জন্য দাঁড়িয়েই গেলেন, তখন উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হলো। এবং সরাসরি আল্লাহর হুকুমে তাঁকে জানাযা পড়ানো থেকে বিরত রাখা হলো। কারণ, এ সময় মুনাফিকদের ব্যাপারে স্থায়ী নীতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলমানদের সমাজে আর মুনাফিকদেরকে শিকড় গেড়ে বসার সুযোগ দেওয়া যাবে না এবং এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে এ দলটির সাহস বেড়ে যায়।
এ থেকে শরীয়তে এ বিষয়টি স্থিরকৃত হয়েছে যে, ফাসিক, অশ্লীল ও নৈতিকতা-বিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং ফাসিক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির জানাযার নামায মুসলমানদের ইমাম ও নেতৃস্থানীয় লোকদের পড়ানো উচিত নয়। তাতে শরীক হওয়াও উচিত নয়। এ আয়াতটি নাযিল হবার পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে, কোনো জানাযায় শরীক হবার জন্য তাঁকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। জিজ্ঞেস করতেন, সে কেমন ছিল। যদি জানতে পারতেন সে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পার।
বিভিন্ন হাদীসে পাওয়া যায়, যারা আত্মহত্যা করত নবীজি তাদের জানাযার নামায পড়তেন না। একটি হাদীসে এসেছে, জাবির ইবনু সামুরা রাদি. থেকে বর্ণিত যে, একজন লোক নিজেকে তীরবিদ্ধ করে মেরে ফেললে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আমি তার জানাযার নামায পড়াব না। (মুসলিম শরীফ, হাদিসক্রম : ২৩০৯)
শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনু তাইমিয়্যা রহ. বলেন, ‘নবীজি ﷺ আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়েননি; তবে সাথীদেরকে বলেছেন, “তোমরা পড়ে নাও।” সুতরাং সর্বসাধারণের জন্য আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়া জায়েয আছে। তবে যাঁরা ধর্মের ব্যাপারে মান্যবর, যাঁদেরকে লোকেরা অনুসরণ করে, তাঁরা যদি অন্যকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে আত্মহত্যাকারীর জানাযা না পড়েন, তাহলে এটা উত্তম।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া : ২৫/২৯০)