আগস্ট ২০২২

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে কুরবানীর পশুর চামড়া নিয়ে চলছে তেলেসমাতি কাণ্ড। কাঁচা চামড়া বিপণন ও সংরক্ষণে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের মাধ্যমে দেশীয় বাজারে পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটানো হয়েছে সম্ভাবনাময় এ পণ্যটির। কুরবানীর ঈদ পণ্যটি সংগ্রহের উৎকৃষ্ট সিজন। কুরবানীর পশুর চামড়া থেকে যে অর্থমূল্য পান কুরবানীদাতারা, তা বণ্টিত হয় সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে। বিশেষত, দেশের কওমী ধারার মাদরাসাগুলো চামড়া সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। এই সিজনে কাঁচা চামড়া বিক্রি করে মাদরাসার গরিব ও এতিম ছাত্রদের বড় একটি ব্যয় সংকুলান করা হয়। কিন্তু বিগত পাঁচ-সাত বছর ধরে চামড়ার দাম পড়তি থাকায় যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাদরাসাগুলোর গরিব ফান্ডের এই আয়ের খাতটি, তেমনি বঞ্চিত হচ্ছেন দরিদ্র শ্রেণির নাগরিকেরা। এমন না যে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কম, কিংবা দেশীয় চামড়ার গুণগত মানে ঘাটতি আছে। বরং গুণগত মানের বিচারে ফরাসিদের ‘ফ্রেঞ্চ কাফের’ পর আমাদের দেশের চামড়াই দুনিয়া-সেরা। এ রকম স্মোথ গ্রেইনের চামড়া বিশ্বের আর কোথাও মেলে না।

গত এক দশকে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে চামড়াজাত পণ্য রফতানির পরিমাণ ও বাজার। আমাদের দেশের চামড়া দিয়ে বিশ্বমানের হুগো বসের মতো প্রতিষ্ঠান জুতা তৈরি করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে। প্রতিষ্ঠানটির তৈরি এক জোড়া জুতা বাংলাদেশের অর্থমানে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ইউরোপের সবচেয়ে বড় জুতা বিক্রেতা ডাচম্যানের প্রায় চার হাজার শোরুমে বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত চামড়াজাত জুতা বিক্রি হয়। এ ছাড়া  আমেরিকা, ইউরোপ জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতেও বাংলাদেশের চামড়ার জুতার বাজার রয়েছে। এশিয়ার জাপানেও খুব পছন্দ বাংলাদেশি জুতা।

ধারণা করা হয়, গার্মেন্টস শিল্পের পর চামড়া শিল্পই এখন দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের অতি সম্ভাবনাময় খাত। দেশে ১১০টিরও অধিক রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার জুতা তৈরি হয়। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনিস, আকিজ, আরএমএম, বেঙ্গল এবং বে’র রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি। এরপরও কাঁচা চামড়া অবহেলিত। কুরবানির সিজন এলে দাম না পেয়ে নদীতে ভাসাতে হয় চামড়া, অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলেন অনেকে।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি পশু কুরবানী হয়। কুরবানীকৃত এ পশুগুলোর কাঁচা চামড়ার ন্যায্য মূল্য না থাকার কারণে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অন্তত ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। বিপরীতে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নিচ্ছেন আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরা।

চামড়া বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মুনাফাখোররা জানে, ন্যায্য মূল্য না পেয়ে বা প্রতিবাদী হয়ে কুরবানীর পশুর চামড়া নদীতে ভাসানো কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলার হার খুব কম, যে চামড়ার স্বাভাবিক মূল্য অন্তত হাজার টাকা, গরিবদের কথা চিন্তা করে কুরবানিদাতারা দাম না পেলে তা ১০০ টাকায়ও বিক্রি করতে রাজি থাকবেন। এই সুযোগটি তারা কাজে লাগাচ্ছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি টাকা তারা অসদুপায়ে নিজেদের পকেটে ভরছে। টাইম লাইন বিবেচনা করলে দেখা যাবে, গত প্রায় ১ দশক ধরে চামড়ার বাজারে এই দুর্বৃত্তায়ন চলছে। কিন্তু কেন যেন বাস্তবিক অর্থে কার্যকর ও প্রভাবশীল কোনো উদ্যোগ সরকারের তরফে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও বিক্রয়ের সঙ্গে যেহেতু কওমী মাদরাসাগুলো সম্পৃক্ত, তাই মাদরাসাগুলোকে সম্মিলিতভাবে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সিন্ডিকেটের কাছে এভাবে জিম্মি হয়ে না থেকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। কুরবানীর পশুর চামড়ার সঙ্গে গরিব মানুষের অধিকার সম্পৃক্ত। পাশাপাশি মাদরাসার গরিব ফান্ডের বড় একটি ব্যয়ও নির্বাহ হয় এর মাধ্যমে। সুতরাং বছর বছর এভাবে বঞ্চনার শিকার না হয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চামড়া কীভাবে ব্যবহার করা যায়, কাঁচা চামড়াকে খাওয়ার উপযোগী করা যায় কি না, কিংবা ট্যানারি-মালিকদের এড়িয়ে সংগৃহীত চামড়া অন্য কোনোভাবে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবসায়িক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় কি না, উলামায়ে কেরাম ও কওমী মাদরাসা অথরিটিকে এসব বিষয়ে সিরিয়াস চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।

—হামমাদ রাগিব

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

সত্য ও সুন্দরের প্রহরায় ৪৮ বছর

প্রতিষ্ঠাতা : শায়খ আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.
নিবন্ধন নম্বর : চ-৪৭৩/০৫

কপিরাইট © ২০২৪ | মাসিক হেফাজতে ইসলাম, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলামের মুখপত্র। Developed By Shabaka IT