প্রশ্ন : অন্তরে নানা ধরনের চিন্তা-ভাবনা উদিত হয়। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, সেই চিন্তাটি অনর্থক হয়ে থাকে। অথবা কোনো না কোনো গুনাহের দ্বারা চিন্তাটি পরিবেষ্টিত থাকে। নেক আমলের চিন্তা উদিত হলেও তার স্থায়িত্ব খুব কম হয়। জানতে চাই—অন্তরের কুচিন্তা বা অনর্থক ভাবনা থেকে কীভাবে মুক্ত থাকা যায়?
উত্তর : অন্তরে চিন্তা-ভাবনার উদয় হওয়া সৃষ্টিগত একটি বিষয়। মানুষ মাত্রই তার অন্তরে সবসময় কোনো না কোনো চিন্তা ঘুরপাক খাবে। তবে মুমিন বান্দার জন্য এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, অন্তরের চিন্তা-ভাবনাকে নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা। অন্তরের চিন্তা-ভাবনাকে যিনি পরিপূর্ণ মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তাঁর পক্ষে ইসলাহে নফস তথা আত্মশুদ্ধি অর্জনে ব্রতী হওয়া সহজ। এর দ্বারা তিনি নফস ও প্রবৃত্তির গোলামি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
হিজরী সপ্তম শতাব্দীর অন্যতম মনীষী আলিম ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি অন্তরের চিন্তা-ভাবনাকে চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন—
১. দুনিয়াবি কোনো জিনিস বা বিষয় লাভ করার ভাবনা
২. দুনিয়াবি কোনো ক্ষতি থেকে মুক্তিলাভ অথবা মুক্ত থাকার ভাবনা
৩. আখিরাতের কোনো কিছু লাভ করার ভাবনা
৪. আখিরাতের কোনো ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার ভাবনা
তিনি বলেন, এই চার প্রকারের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে মুমিন মাত্রই সতর্ক থাকা উচিত। অন্তরে কোনো চিন্তার উদয় হওয়ার সাথে সাথে খেয়াল করতে হবে, চিন্তাটি উপরোক্ত চার প্রকারের কোন প্রকারে পড়ে। যদি আখিরাত বিষয়ক (অর্থাৎ শেষোক্ত দুই প্রকারভুক্ত) হয়, (যেমন : কাউকে সৎ কাজের আদেশ দেবেন বা অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবেন, অথবা দু রাকাত নামাজ পড়বেন, কোনো অসহায়কে সহায়তা করবেন, বা যেকোনো ধরনের ভালো কাজ করবেন যার প্রতিদান আখিরাতে পাওয়া যাবে, অথবা কোনো গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকবেন যে গুনাহের জন্য আখিরাতে শাস্তি অবধারিত) তাহলে সেই ভাবনাটি যত দ্রæত সম্ভব বাস্তবায়ন করে ফেলা উচিত। আর যদি চিন্তাটি দুনিয়াবি কোনো কিছু অর্জন করা বা দুনিয়ার কোনো ক্ষতি থেকে মুক্তিলাভের বিষয়ে হয়, তাহলে তা করা কতটুকু জরুরি, শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না, এসব বিষয় খেয়াল করা আবশ্যক। যদি জরুরি হয় এবং শরয়ীভাবেও অনুমোদিত থাকে, তাহলে সেই চিন্তা বাস্তবায়ন করা। অন্যথায় তা থেকে বিরত থাকা এবং সেই চিন্তাটিও অন্তর থেকে সরিয়ে ফেলা।
এখানে চিন্তা-ভাবনার প্রথম যে দুটো প্রকার ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ উল্লেখ করেছেন, মূলত এ দুটো প্রকারই আমাদের জন্য অধিক খতরনাক। এখানে শয়তানের ওয়াসওয়াসা ও ধোঁকা সবচেয়ে বেশি কাজ করে। দুনিয়া বা দুনিয়াসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ ভাবনাই গুনাহের উৎস হয়ে থাকে। তাই বিতাড়িত ইবলিস বান্দার অন্তরকে এই ভাবনাগুলোর দিকে বেশি আকৃষ্ট করে। বান্দার কাছে এসব ভাবনাকে মজাদার ও আকর্ষণীয় করে তোলে। আর গুনাহের কাজ বাস্তবে করা কখনো কখনো কঠিন হলেও সেই গুনাহ বিষয়ে মনের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা তৈরি করা সহজ। যেমন ধরা যাক, পরনারী নিয়ে ভাবনা। সামাজিকতার খাতিরে হলেও পরনারীর সঙ্গে একজন পুরুষ সহজে মেলামেশা করতে পারে না। কিন্তু মনের রাজ্যে সেই নারীকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। শয়তান এই সুযোগটাই গ্রহণ করে। নারীকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনায় বিশেষ একধরনের মোহ ও স্বাদ তৈরি করে দেয়। তাই, মুমিনের উচিত চিন্তা-ভাবনার এই স্বাদ ও মোহ সম্পর্কে সতর্ক থাকা। গুনাহমূলক চিন্তা যখন মনে উদিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে মনকে সেই চিন্তা থেকে ঘুরিয়ে নেওয়া।
স্বাভাবিকভাবে অন্তরে যে মন্দ ভাবনা জাগে, তা ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু অন্তরে উদিত সেই মন্দ ভাবনাটিকে স্থায়িত্ব দিলে এবং তা বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্প করলে উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কেননা, গুনাহের প্রতিজ্ঞা করাও গুনাহ। ইমাম গাযালী রহ. বুখারী শরীফের ৩১ নম্বর ও মুসলিম শরীফের ২৮৮৮ নম্বর হাদীসকে এ বিষয়ে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন। হাদীসটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান, ‘দুজন মুসলিম যখন তরবারি নিয়ে পরস্পর লড়াইয়ে নামে, তখন হত্যাকারী ও নিহত—উভয়েই জাহান্নামী।’ সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ‘এখানে নিহত ব্যক্তির কী দোষ?’ নবী আলাইহিস সালাম জবাবে বললেন, ‘সে-ও তার সঙ্গী লোকটিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল।’
এই হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, কারো অন্তরে গুনাহের ভাবনা জাগার পর গুনাহের সেই কাজটি বাস্তবায়নে সে যদি দৃঢ় সংকল্প করে ফেলে, তাহলে গুনাহের ভাগিদার হবে।
মন্দ ভাবনা গুনাহের বাস্তবায়নকে সহজ করে তোলে। তাই প্রত্যেকের উচিত, মন্দ ভাবনার ব্যাপারে নিজের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ বিষয়ে সর্বদা আল্লাহ তাআলার সাহায্য কামনা করা। মন্দ ভাবনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য হাদীস শরীফে বিশেষ দুআ বাতলানো আছে—
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قُلُوْبَنَا عَلٰي دِيْنِكَ، يَا مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا إِلٰي طَاعَتِكَ
অর্থ : হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমাদের অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত করুন। হে অন্তরসমূহের পরিচালনাকারী, আমাদের অন্তরকে আপনার আনুগত্যের পথে পরিচালিত করুন।
এই দুআ বেশি বেশি করে পাঠ করা। পাশাপাশি অন্তরকে সবসময় সুচিন্তা ও নেক ভাবনার মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করা। বস্তুত, মানুষের মনে যত ধরনের ভাবনার উদয় ঘটে, তার মধ্যে সর্বোত্তম ভাবনা হলো, যা আল্লাহ তাআলার জন্য হয়।
আর যে ভাবনাগুলো আল্লাহ তাআলার জন্য হয়, ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহ. এ ধরনের ভাবনাকে ৫ ভাগে উল্লেখ করেছেন—
১. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ আয়াতসমূহ অর্থাৎ কুরআনুল কারীম নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করা। আল্লাহ তাআলার প্রতিটি বাণীকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা।
কুরআনের অর্থ বোঝার সক্ষমতা না থাকলে সক্ষমতা তৈরির চেষ্টা করা। কেননা কুরআন শুধু তিলাওয়াতের জন্য নাযিল হয়েছে, এমন নয়। তিলাওয়াত তো হলো অনুধাবনের মাধ্যম মাত্র। কোনো এক বুযুর্গের উক্তিÑ
أُنْزِلَ الْقُرْآنُ لِيُعْمَلَ بِهِ، فَاتَّخَذُوا تِلَاوَتَهُ عَمَلًا
অর্থ : কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে আমলের জন্য। অতএব তোমরা আমলের জন্য তিলাওয়াত করো।
২. আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য কুদরতি নিদর্শন। সেগুলোর দিকে খেয়াল করা, সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা। আল্লাহ তাআলার কুদরত নিয়ে এভাবে চিন্তা-ফিকির করা কুরআনের নির্দেশ। কুরআনে এ ধরনের চিন্তা-ফিকিরকারীদের সপ্রশংস বর্ণনা বিবৃত হয়েছে। যারা আল্লাহ তাআলার কুদরত নিয়ে চিন্তা-ফিকির করে না, তাদের নিন্দা করা হয়েছে।
৩. আল্লাহ তাআলার অমূল্য অসংখ্য দয়া ও অনুগ্রহ রয়েছে আমাদের উপর। সেগুলো নিয়ে ভাবা, চিন্তা করা।
উল্লিখিত এ তিন ধরনের ভাবনা মানুষকে পর্যায়ক্রমে আল্লাহর ওলী বানিয়ে দেয়। মানুষ আল্লাহর পরিচয় খুঁজে পায় এ সকল ভাবনায়, ফলে আল্লাহর ভালোবাসায় তার জীবন রঙিন হয়ে ওঠে।
৪. নিজের দোষত্রæটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। এই ভাবনা মানুষকে ক্রমাগত একজন ভালো মানুষে পরিণত করে। বহুবিধ কল্যাণের দরজা খুলে দেয়। অসৎ প্রবৃত্তিকে দুর্বল করে ফেলে। এবং সৎ প্রবৃত্তি জাগ্রত করে।
৫. প্রতিদিনকার গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যকীয় আমল ও ব্যক্তিগত ওযীফা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা। এই চিন্তাপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে থাকলে সময় অপচয়ের সম্ভাবনা কমে যায়।
উল্লিখিত পাঁচ প্রকারের চিন্তাভাবনা ছাড়া অন্য যেসকল ভাবনা মানুষের মনে উদয় হয়, তা শয়তানের ধোঁকার ফলেই হয়। অন্তর যতক্ষণ অলস থাকবে, ততক্ষণ অমূলক ভাবনার উদয় ঘটতেই থাকবে। স্বাভাবিকভাবে তা দোষণীয় কিছু নয়। কিন্তু সচেতনভাবে কেউ এ ধরনের ভাবনায় তলিয়ে যেতে থাকলে তা দোষণীয় বলে বিবেচিত হবে।
ইমাম ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহ. বলেন, মানুষের হৃদয় একটি সাদা কাগজের মতো। মস্তিষ্কের ভাবনা তাতে অংকিত হয়। মিথ্যা, ধোঁকা ও গুনাহের চিন্তাভাবনা করতে থাকলে কদাকার অসংখ্য দাগে সাদা পাতাটি ভরে ওঠে। পক্ষান্তরে ভালো চিন্তাও তার মাঝে সুন্দর প্রতিফলন ঘটায়। দৃষ্টিনন্দন রঙিন দাগে অন্তর হয়ে ওঠে সুশোভিত।
আমীরে আঞ্জুমান হযরত মুফতি মুহাম্মাদ রশীদুর রহমান ফারুক বর্ণভী দা. বা.-এর তত্ত¡াবধান ও নির্দেশনার আলোকে উত্তরটি লিখেছেন হামমাদ রাগিব